×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষাব্যবস্থায় বারবার পরিবর্তন কতটা ফলপ্রসূ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৩৬ এএম

শিক্ষাব্যবস্থায় বারবার পরিবর্তন কতটা ফলপ্রসূ

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নিজের হতাশার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। তার মতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে আংশিকভাব প্রথম সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সব সাবজেক্টে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়াও ২০০৬ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি ও ২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষা নেয়া শুরু হয়। অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষার পূর্বেই দুটি পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হতো শিক্ষার্থীদের। যেখানে ঢালাওভাবে জিপিএ-৫ পাওয়ার নজিরও আছে। তবে বর্তমানে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়াও ক্লাস নাইনে চলমান সিস্টেম অনুযায়ী ৩টি বিভাগ (বিজ্ঞান, কলা ও ব্যবসা) প্রচলিত থাকলেও আগামীতে তা একটি বিভাগ করার উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। গাইড বইয়ের নির্ভরতা, কোচিং, নোটবই ইত্যাদি বিলুপ্ত করার জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের আবির্ভাব ঘটে। মূলত শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সৃজনশীল মেধা ব্যবহার করে পড়াশোনা ও পরীক্ষায় উত্তর করানো ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করায় সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রথম দিকেই সমস্যার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য ছাত্রছাত্রীরা আগে থেকে বেশি গাইড, নোট কিংবা কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ায় এই পদ্ধতির বাস্তবিকতা যাচাই এখন পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও এইচএসসি শেষ করে যখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন এই পদ্ধতি আর থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মতো করে কোর্স কারিকুলাম তৈরি করছে, সে অনুযায়ী পরীক্ষা নিচ্ছে। আর তাই এইচএসি পর্যন্ত পড়াশোনার পদ্ধতির সঙ্গে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতির সামাঞ্জস্য না থাকাটাও চিন্তার বিষয়! ২০০১ সালে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রথম গ্রেডিং সিস্টেম চালু হয়। প্রথম বছর এসএসসি পরীক্ষায় মাত্র ৭৬ জন ছাত্রছাত্রী জিপিএ পাঁচ অর্জন করে। তবে ২০১০ সালে এসে জিপিএ-৫ পায় ৫২১৩৪ জন শিক্ষার্থী। মাত্র ৪ বছর ব্যবধানে ২০১৪ সালে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন শিক্ষার্থী এসএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করে! এরপর থেকেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে! গত বছর দেখা যায় মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন! যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। অথচ উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে আসন রয়েছে এর এক-তৃতীয়াংশ! বর্তমানে জিপিএ-৫ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ট্রল করতে দেখা যায়। গত বছর একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল থেকে কয়েকজন এসএসসি উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে এক সাংবাদিকের করা সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তর শুনে হতবাক হয়েছে দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ! যেসব ছাত্রর অধিকাংশই এসএসসিতে জিপিএ-৫ কিংবা ৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে! অথচ ভালো ফলাফল করার পরও তারা জানে না স্বাধীনতা দিবস কত তারিখ কিংবা আমাদের রণ সংগীতের রচয়িতা কে। ভালো ফলাফল করা এসব শিক্ষার্থীর ধারণা নেই অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কেও! অথচ গ্রেডিং সিস্টেম চালুর আগে প্রচলিত স্টার মার্কস পেলে এলাকাতে ওই শিক্ষার্থীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ত! সামাজিকভাবে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন পরিবর্তন আনলেও তা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে? ঠিক কয়েক বছর আগের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে সক্ষম হয়। যেটা বেশ আলোচনার জন্ম দেয় দেশজুড়ে। দেশে যখন এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-৫ এর মহোৎসব চলছে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সেসব শিক্ষার্থীর ভরাডুবি হচ্ছে কেন? আমাদের দেশে দেখা যায় অনার্স মাস্টার্স করে দীর্ঘদিন বেকার থাকতে হচ্ছে শিক্ষিতদের একটি বড় অংশকে। জেনারেল সাবজেক্টগুলোতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ছে! কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকার পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাও কিছুটা দায়ী এ অবস্থার জন্য! প্রতি বছর তাই লাখ লাখ বেকার যুক্ত হচ্ছে এই তালিকায়। অথচ উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা কারিগরি শিক্ষায় জোর দিচ্ছে, বিশেষ করে অনেক দেশেই প্রায় ৪০ শতাংশ কারিগরি শিক্ষা চালু আছে। আমাদের দেশে বিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েটদের ব্যাংকের চাকরির জন্য অনার্স শেষ করে ব্যাংকিং টার্ম পড়তে হচ্ছে! বুয়েট কিংবা মেডিকেল কলেজে পড়ে বিসিএস দিয়ে জেনারেল ক্যাডারে চলে যাচ্ছে! এমন সংখ্যাই এখন বেশি! গত বছরে অনুমোদন পেয়েছে নতুন শিক্ষা পদ্ধতির। নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে দশম শ্রেণিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা, যেখানে থাকছে না বিজ্ঞান, ব্যবসা কিংবা মানবিকের বিভাজন। নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। নীতি নির্ধারকরা হয়তো অনেক পরিকল্পনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে শিক্ষার তিনটি স্তরের মাঝে যেন সামাঞ্জস্য থাকে সেটা নিয়ে কাজ করা উচিত। সব সাবজেক্টে সৃজনশীলতার প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা উচিত। ঢালাওভাবে জিপিএ-৫ না বাড়িয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের দিক নজর দেয়া উচিত। নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।

কে এম মাসুম বিল্লাহ : লেখক ও ব্যাংক কর্মকর্তা, দুমকি, পটুয়াখালী। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App