×

জাতীয়

আইএমএফের প্রস্তাব মেনেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা আজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৪৯ এএম

আইএমএফের প্রস্তাব মেনেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা আজ

ছবি: সংগৃহীত

পুরনো বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন বছরেও মূল্যস্ফীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখী। অস্থির মুদ্রাবাজারও। ডলার লেনদেন হচ্ছে ১০০ টাকার উপরে। রয়েছে করোনার ধাক্কা। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তারল্য সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে লাগাম টানাসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রাখতে ঘোষিত হবে আগামী ৫ মাসের পথনকশা। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডকে যেন নিরুৎসাহিত না করা হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই আজ রবিবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর যাবত একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত ছিল বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে। তাই আজ রবিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। এবারের মুদ্রানীতি হবে সতর্কতামূলক, পুরোপুরি সংকোচন বা স¤প্রসারণমূলক নয়।

জানা গেছে, বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের শর্তে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা ছাড় করা হবে বলে সরকারকে জানিয়েছিল আইএমএফ। সেই উদ্দেশ্যে ৫ দিনের সফরে আইএমএফ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত এম সায়েহ শনিবার দুপুরে ঢাকায় এসেছেন। তিনি ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় থাকবেন। এ সময়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করা হবে।

সূত্র জানায়, আইএমএফের সঙ্গে ঋণের বিষয়ে সরকারের একটি নীতিগত সমঝোতা হয়েছে। এখন বাকি রয়েছে শুধু আনুষ্ঠানিকতা। কিছু শর্ত এরই মধ্যে সরকার বাস্তবায়ন

করেছে। এদিকে আইএমএফের শর্তের সঙ্গে মিল রেখে আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে। এতে ঋণের সুদের হার সীমিত পরিসরে বাড়ানোর আভাস দেয়া হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার নিয়স্ত্রণে মুদ্রানীতির ব্যবহার করবে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদের হারও বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের অস্থিরতা রোধ এবং তারল্য সংকট সামাল দেয়াই হবে নতুন মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, সরকারি ঋণেরও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থনীতিতে চলমান সমস্যার সমাধানের গুরুত্ব থাকবে মুদ্রানীতিতে। অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আবার বছরে দুবার মুদ্রানীতির যে ঘোষণা দিয়েছে সেটি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। দুবার মুদ্রানীতি দিলে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। তবে মুদ্রানীতির তাৎপর্য কমে গেছে সুদহার নির্দিষ্ট থাকার কারণে। অর্থাৎ ঋণের ৯ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট হওয়ায় মুদ্রানীতিতে নতুন কিছু থাকে না। তিনি আরো বলেন, সুদহারের নির্ধারিত সীমা যদি উঠিয়ে দেয় তাহলে নীতি সুদহার অর্থাৎ রেপো, রিভার্স রেপো রেট বিভিন্ন সূচক দিয়ে মুদ্রানীতিকে ব্যাখ্যা করা যায়। আর সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ বহাল থাকলে অন্য কিছু কাজ করবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এক বছরের মুদ্রানীতি কোনোভাবেই ঠিক না। ছয় মাস না পারলে তিন মাস করবে। শুধু টার্গেট করে নির্ধারণ করলে হবে না। টার্গেট অর্জনে কী কী পদক্ষেপ নেবে ব্যাংকিং সেক্টর এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে কীভাবে সহায়তা করবে তা ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একাই মূল্যস্ফীতি ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ঠিক করে। এটা কিন্তু সমন্বিত পদক্ষেপ। এখানে অর্থ, পরিকল্পনা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে। কিন্তু বাজার মনিটর করা ও নিয়ন্ত্রণের কোনো চিহ্ন নেই।

জানা গেছে, বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের মেয়াদে এটি তার প্রথম মুদ্রানীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক আগে প্রতি ৬ মাসের আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেও গত দুই অর্থবছর তা এক বছরের জন্য করা হয়। আর করোনার কারণে গত দুই বছর আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি ঘোষণা করেন বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির। কিন্তু আইএমএফের পরামর্শে আজ রবিবার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে গুরুত্ব পাবে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আটকে রেখে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনা এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক) অর্জনের উদ্যোগ। মূলত অর্থনীতিতে চাপ সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা যেন ফেব্রুয়ারি মাসেই পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে বছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণার আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে আবার এক অর্থবছরে (আর্থিক বছর ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ জুন) দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে বাজারে নগদ টাকার জোগান কেমন হবে, কতটা ঋণ দেয়া হবে উদ্যোক্তাদের, সরকারই বা কতটুকু ধার করতে পারবে ব্যাংকিং খাত থেকে- এসব বিষয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধানসহ ও নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত থাকবেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। আর পরিসংখ্যান ব্যুরো বছরে দুবার এসব তথ্য প্রকাশ করে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বলে আইএমএফকে জানায়।

তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গত নভেম্বর মাস শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এজন্য মূল্যস্ফীতি সরকার নির্ধারিত মাত্রায় সীমিত রাখা চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। নতুন মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তারল্য সরবরাহ ঠিক রাখা মুদ্রানীতির মূল কাজ। মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে প্রতি বছরের মতো এবারো দেশের অর্থনীতিবিদসহ সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক, মুদ্রা সরবরাহ, সংরক্ষিত মুদ্রা ও সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে।

আইএমএফ প্রতিনিধির আগমন : ৫ দিনের সফরে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ শনিবার দুপুরে ঢাকায় এসেছেন। তিনি ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় থাকবেন। এ সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এসব বৈঠকে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করা হবে। আইএমএফ ঢাকা সফর সম্পর্কে বলেছে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি সহনশীল রাখতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করে আইএমএফ। এজন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে ঢাকা সফর করছেন মনসিও সায়েহ।

সূত্র জানায়, আজ রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর আগামী ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। ১৮ জানুয়ারি পদ্মা সেতু ভ্রমণ করবেন এবং ওইদিনই তিনি ঢাকা ছাড়বেন।

আইএমএফ বলেছে, বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা করে সায়েহ আইএমএফের সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেবেন। ওই প্রতিবেদনটি আইএমএফের পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা হবে। এর ভিত্তিতে বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত করা হবে। আইএমএফের মতে, বাণিজ্য ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকুচিত হওয়ার কারণে সংকটের সীমানায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এসব কারণে ব্যয়ের দিক থেকে ভোক্তাদের পরিবর্তন এসেছে অর্থাৎ কম খরচ করতে পারছেন ভোক্তারা। অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ পাচ্ছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে বলে আশা করছে সংস্থাটি। আইএমএফ মনে করছে, রাষ্ট্রীয় তহবিল বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ধিত মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় ঋণটি ঢাকার জন্য বহুলাংশে একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও। সরকার আশা করছে, ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে। প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার মিলবে। এরপর প্রতি ৬ মাস পরপর একটি করে কিস্তি দেয়া হবে। ৭ কিস্তিতে দেয়া এ ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। ঋণের গড় সুদহার ২.২ শতাংশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App