রসের স্বাদ নিতে আসা লোকের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে গাছিরা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৬:১৪ পিএম
ছবি: ভোরের কাগজ
এক সময় খেজুর গাছে ভরপুর ছিল রাজধানী ঢাকার কোল ঘেঁষে অবস্থিত মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা। শস্য-শ্যামেল ঐতিহ্যর ধারক বহন করা সিংগাইর উপজেলাটি এখন ইটভাটার নগর। ভাটার কারণে মাত্র কয়েক বছরে ধ্বংস হয়েছে খেজুরের গুড় উৎপাদন ও ভোজন বিলাসীদের রসের উৎস খেজুর গাছ। বতর্মানে খেজুরের গুড় ও রসের চাহিদার ১০ শতাংশও যোগান দিতে পারছেন না এ অঞ্চলের গাছিরা।
খেজুর রসের চাহিদা ব্যাপক থাকায় এ এলাকায় সাধারণত ১ কেজি খেজুরের রস ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রসের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ এলাকার গাছিদের রস থেকে গুড় তৈরির তেমন একটা সুযোগ নেই বললেই চলে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের ফেলার মোড়ে রাত ৩ টার পর থেকেই কাঁচা রসের স্বাদ নিতে স্থানীয়সহ পার্শ্ববর্তী সাভার, দোহার, নবাবগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ উপজেলার এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে নামিদামি ব্রান্ডের গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে শত শত লোক জড়ো হতে থাকেন। সকালে এখানে রীতিমত রস খেতে আসা লোকের মিলন মেলা ঘটে। রস খেতে আসা সবাইকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তবে রস পিয়াসি অনেকের ললাটে জুটে না কাঙ্খিত রসের স্বাদ। এতে মন খারাপও হয় অনেকের। অনুরুপ দৃশ্য ভোর বেলা সিংগাইর পৌর এলাকার ঘোনাপাড়া রোডে ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন সামনে, জয়মন্টপ ইউনিয়নের মিরের চর ও রামনগরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে।
খেজুরের রস খেতে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর থেকে আসা রাসেল মিয়া বলেন, খেজুরের রস আমার খুব পছন্দ। আমার বাড়ির পাশে না থাকায় ভোরে ঘুম থেকে উঠে নয়াপাড়ায় রস খেতে এসেছি। আমার পরিবারের অন্যদের জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছি।
কথা হয়- রস খেতে না পারা জনৈক মো. বকুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, সাভার থেকে এই হাঁড় কাপানো শীতের সকালে রস খেতে এসে রস না পেয়ে শীতের কষ্ট আরো বেড়ে গেছে। বকুলের মত একই অবস্থা সুজন, মাসুদ ও শালমানসহ অনেকের ।
রাজশাহী থেকে আসা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী (গাছি) মো. হাফিজুল ইসলাম ও মো. সুরুজ মিয়া বলেন, এ এলাকায় খেজুর গাছ কইম্যা গেছে। তাছাড়া এহন দেশে মেঘ- বৃষ্টি ঠিক মতো অয়না। দিন বদলাই গেছে। তাই এহন আর আগের নাহাল গাছে রস পড়ে না। ম্যালা লোক রস খ্যাবের জন্য আসে। কম লোককেই রস দিবার পারি। ম্যালা ম্যালা লোক ফিরা যায়। এই ঠান্ডায় লোক ঘুইড়া গেলে আমাগো কষ্ট অয়।
খেজুরের রস সংগ্রহ করে গুড়ের কারিগর আবদুর রশিদ বলেন, রাজশাহী থেকে এ বছর প্রথম সিংগাইরে এলাম। এলাকায় যাদের খেজুরের গাছ রয়েছে তাদের কাছ থেকে শীত মৌসুমের জন্য খেজুর গাছ লিজ নিয়েছি। তিন দিন পরপর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় হাড়ি বেঁধে রস সংগ্রহ করি। রসের বেশ চাহিদা থাকায় সব রস বিক্রি হয়ে যায়। রস থেকে গুড় তৈরির সুযোগ হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।
এদিকে, এলাকাবাসী জানিয়েছেন- এক সময় এ অঞ্চলে অনেক খেজুর গাছের বাঁক (বাগান) ছিল। মালিকেরা গাছগুলো লোভে পড়ে ইটভাটায় বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে এখন খেজুর গাছ কমে গেছে। তবে এখন আর ইটভাটায় গাছ পোড়ানো হয় না। যেগুলো আছে গাছি সংকট থাকায় সেগুলোর পরিচর্যা হয় না। বতর্মানে চাহিদার তুলনায় রস ও গুড় অপ্রতুল। দামও অনেক বেশি।
প্রসঙ্গত, পড়ন্ত বিকলে শুরু হয় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ। গাছির ধারলো দায়ের আঁচড়ে শুরু আর তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ভোর পর্যন্ত। শীতের শুরু থেকে চলে সিংগাইর তথা মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে রস ও গুড় তৈরির কাজ। কুয়াশা মোড়ানো প্রতিটি সকাল গাছিদের কাছে হাজির হয় নতুন স্বপ্ন নিয়ে। গাছ থেকে নামিয়ে আনা হয় হাড়ি ভর্তি রস। আর এ রস খাওয়ার ভালো সময় ভোর বেলা।