×

সারাদেশ

প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা মাঝিরা টার্গেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩০ এএম

প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা মাঝিরা টার্গেট

উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা শিবিরে এপিবিএনের টহল

এক বছরে ক্যাম্পে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা হত্যা

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সন্ধ্যা নামলেই ক্যাম্পে দুর্বৃত্তরা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত চার মাসে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। এছাড়া অন্তত ৬০০ থেকে ৭০০ রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) আতঙ্কে ভুগছেন। এর মধ্যে শতাধিক মাঝি আত্মগোপনে চলে গেছেন।

গত বছর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর পর পরই ক্যাম্পে সিক্স-মার্ডার, অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় ‘আরসার অস্তিত্ব’ নিয়ে কথা ওঠে। তখন থেকে ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্লকে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবু রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের হত্যার ঘটনা কমেনি। মুহিবুল্লাহ হত্যার পর গত এক বছরে ক্যাম্পে মাঝিসহ খুন হন প্রায় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা। এর মধ্যে চলতি মাসেই গুলিতে ও কুপিয়ে ৩ রোহিঙ্গা মাঝিকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করছেন রোহিঙ্গা নেতারা।

কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ রফিক বলেন, মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যার এক বছর পার হয়েছে। মুহিবুল্লাহ হত্যার বিষয়টি পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মাঝিদের (নেতা) হত্যা বন্ধ হয়নি। এতে আমরা যারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করি, তারা খুবই বিপদে আছি। তবে এটাও সত্য, এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা আমাদের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছেন।

তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিই শুধু নয়, বিভিন্ন অপরাধ চক্রে যুক্ত হতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করা হয়। এসবের কারণে ক্যাম্পের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর লম্বাশিয়া ক্যাম্পের এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে সভাপতি মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং বালুখালীর ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় আরসাবিরোধী মাদ্রাসা শিক্ষক মৌলভি আকিজসহ ছয়জন খুন হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো তৎপরতা বাড়ায়। এতে ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তবে গত অক্টোবর থেকে ক্যাম্পে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের টার্গেট করে হামলার ঘটনা ঘটছে। এতে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন।

পুলিশ ও এপিবিএন সূত্র জানায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে ২০২২ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ২০টি ঘটনায় ২৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পে একসঙ্গে সিক্স-মার্ডারের ঘটনা আলোচিত ছিল।

তবে গত চার মাসে ক্যাম্পে ২০ রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। এর মধ্যে মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবকরা ছিলেন। সর্বশেষ গত শনিবার গভীর রাতে পালংখালী ইউনিয়নের ৮-ওয়েস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের বাসিন্দা আব্দুস সোবহানের ছেলে সাব মাঝি মোহাম্মদ সলিমকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে একই দিন সন্ধ্যায় ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ-ব্লকের হেড মাঝি মোহাম্মদ রশিদ (৩৬) ছুরিকাঘাতে খুন হন। ৩১ ডিসেম্বর টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা ক্যাম্পে হাকিম আলীর ছেলে জোবায়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এর আগে, গত ২৬ ডিসেম্বর বালুখালী ক্যাম্পে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা মাঝিকে হত্যা করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রাণ হারান আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে

চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।

এছাড়া ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ে ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে ও মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)। এসব ঘটনায় ১২টি মামলায় ২৩ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মিয়ানমারের মুসলিম সন্ত্রাসবাদী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং মাদক ও মানবপাচারে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর বিপক্ষে সদা সোচ্চার তারা।

‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ)-এর নেতা সৈয়দ মাহামুদ বলেন, আমরা যারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে এবং মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধ ঠেকাতে কাজ করছি, তারা সবাই প্রতিমুহূর্তে প্রাণ হারানোর ভয়ে আছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ক্যাম্পে মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) ও স্বেচ্ছাসেবীদের কারণে অপরাধীদের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালাচ্ছে। অনেক মাঝি শুধু অপরাধীদের অবস্থানের তথ্য দেয়ার কারণেও আক্রান্ত হয়েছেন। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ ছাড় পাবে না।

ক্যাম্প এলাকায় টহল এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে দাবি করে তিনি আরো বলেন, এপিবিএনের আওতাধীন ক্যাম্পগুলোতে প্রতি রাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব পালন করছেন। এতে ক্যাম্পের অপরাধীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App