×

মুক্তচিন্তা

জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও বিজয়ের পরিপূর্ণতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৪৯ এএম

বাঙালি জাতির জীবনে ১০ জানুয়ারি অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২-এর এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করে। যদিও ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। কিন্তু বাংলার মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। যতক্ষণ মহান নেতা ফিরে না এসেছেন, ততক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়, যেদিন জাতির জনক স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের প্রধান কারাগার লায়ালপুর জেলে রাখা হয়েছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সামরিক আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। বিচারের রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন বিনা শাস্তিতে সে পার পাবে না। বিচারটা ছিল প্রহসনের। গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি আদালতে চুপচাপ বসে থাকতেন। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে তার পক্ষে নিয়োগ করা আইনজীবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মুজিব নিজের পক্ষে কোনো অবস্থান নিতে চান কি না।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনো অধিকার এদের নেই। আইনের দিক দিয়ে কোনো বৈধতা এই আদালতের নেই।’ (পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন, আহমেদ সালিম) ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর প্রহসনমূলক বিচারের রায়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির দণ্ড হয়। পরে তাঁকে লায়ালপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় মিয়ানওয়ালি জেলে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তার কারাকক্ষের পাশে কবর খোঁড়া হয়।’ আহমেদ সালিম লিখেছেন, ‘জেলের ডেপুটি সুপার ফজলদাদ একদিন ব্যারাকে এসে ৮ জন বন্দিকে বাছাই করলেন। এদের দিয়ে ৮ ফুট লম্বা, ৪ ফুট প্রশস্ত ও ৪ ফুট গভীর গর্ত খোঁড়া হলো। উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলেন সেই রাতেই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেয়া হবে। কিন্তু সেই রাতে কিছু ঘটল না। ফাঁসি দেয়ার নির্ধারিত দিন জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যদি মুজিবকে ফাঁসি দেয়া হয় তবে বাঙালির ক্রোধের লক্ষ্য হবে পূর্বাঞ্চলে মোতায়েনকৃত পাকবাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার থেকে সর্বনিম্ন সৈনিক পর্যন্ত সবাই। ভুট্টোর উপদেশ অনুসারে ইয়াহিয়া খান মুজিবের ফাঁসি স্থগিত রাখেন। ১৫ দিন পর একইভাবে গর্ত খোঁড়ার হুকুম আসে। এবারো শেখ মুজিবের ফাঁসি দেয়া হলো না। এমনি প্রক্রিয়া ৩ বার ঘটেছিল এবং ৩ বারই তার ফাঁসি পিছিয়ে দেয়া হয়।’ ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে, ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক রাখার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতের আকাশসীমা পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ থাকায় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে তাঁকে মুক্তি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাঁকে লন্ডন পৌঁছে দেয়। দ্রুতগতিতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে ব্রিটিশ সরকার। বিকালে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। আন্তরিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এডওয়ার্ড হিথ বলেন, ‘আপনাকে কী সহযোগিতা করতে পারি বলুন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি।’ এডওয়ার্ড হিথ ত্বরিৎগতিতে ব্যবস্থা নেন। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে চারদিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে। রণক্লান্ত যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সংগ্রামী জনতা, অশ্রæভারাক্রান্ত চোখে সন্তানহারা জননী, স্বামীহারা পতœী, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা সব দুঃখকে জয় করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা ভুলে গর্বোদ্ধত মস্তকে সবাই অধীর আগ্রহে সেদিন অপেক্ষায় ছিল দুহাত বাড়িয়ে জাতির জনককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য। ঢাকায় যখন সাজ সাজ রব, তখন সকাল হতেই দিল্লির রাজপথ ধরে হাজার হাজার মানুষের মিছিল পালাম বিমানবন্দর ও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিল্লির জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু একান্তে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি ঋণী। আপনি আমার বাংলার মানুষকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন; আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে আপনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী। প্রধানমন্ত্রী, আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ। আপনি কবে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন।’ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার স্বরে বলেছিলেন, ‘আপনি যেদিন চাইবেন।’ বঙ্গবন্ধু এমন বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, এ রকম একটি অবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যর্পণের বিষয়টি আলাপ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করে নেন। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশ সীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে চেপে রওনা দেই। সুদৃশ্য তোরণ, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দুপাশে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ময়দানে পৌঁছলাম। বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই মনে হয়েছে, জাতির জনক জীবনভর এমন একটি দিনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি তবু সমুজ্জ্বল। সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা। হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগঘন ভাষায় বললেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ জাতির জনকের দুটি স্বপ্ন ছিল- বাংলাদেশ স্বাধীন করা এবং দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে প্রথম স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। আরেকটি স্বপ্ন বাস্তবায়নে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে জাতির জনককে হত্যা করা হলো। আমাদের সৌভাগ্য তাঁর দুই কন্যা তখন বিদেশে অবস্থান করায় রক্ষা পান। ’৮১-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা আমরা তুলে দিয়েছিলাম। সেই পতাকা হাতে নিয়ে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। প্রতিপক্ষের শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচক আজ ইতিবাচক অগ্রগতির দিকে ধাবমান। করোনা অতিমারি সফলভাবে মোকাবিলা ও দেশের মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন প্রদান করে তিনি মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সম্প্রতি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞার যে কূটকৌশল চলছে আশা করি সেই পরিস্থিতিও ধৈর্যের সঙ্গে তিনি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বজুড়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহন মেট্রোরেল চালু করেছেন। যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে জাতির জনক ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আজ তা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাবেন এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবেন। তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App