×

জাতীয়

তীব্র শীতে বাড়ছে রোগবালাই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৭ এএম

তীব্র শীতে বাড়ছে রোগবালাই

ফাইল ছবি

৫৪ দিনে পৌনে ৪ লাখ মানুষ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত

বেশি আক্রান্ত শিশু ও বৃদ্ধ

শীতে কাবু পুরো দেশ। কোনো কোনো অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সহসাই কমছে না শীতের দাপট। চলতি মাসজুড়েই ঘন কুয়াশা ও হাড়কাঁপানো শীতের ‘খাচায় বন্দি’ থাকবে দেশ। এদিকে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শীতকালীন রোগবালাই। এরই মধ্যে রাজধানীসহ সারাদেশে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, সিওপিডিজাতীয় শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু ও বয়স্ক।

তথ্য উপাত্ত বলছে, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, সিওপিডিজাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগগুলো শুধু শীতকালীন রোগ না হলেও শীতে এসব রোগের প্রকোপ কিছুটা বেড়ে যায়। যাদের আগে থেকে ঠাণ্ডার সমস্যা আছে তাদের নিউমোনিয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। এটি যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে কম বয়স এবং বেশি বয়সে এই রোগে আক্রান্তের আশঙ্কা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর দেশে ২৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। যা ৫ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর মোট হিসাবের ১৮ শতাংশ। ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের পাশাপাশি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদেরও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ হিসেবে অপর্যাপ্ত-দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আগে থেকেই নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণ ও অনিরাপদ পানি পানের ফলেও শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে বলে জানান তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫৪ দিনে (১৪ নভেম্বর থেকে গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত) শীতকালীন রোগে মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের। আর এআরআই বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে পৌনে ৪ লাখের মতো মানুষ। এর মধ্যে এআরআইতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৩৩ জন, যার মধ্যে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার ৬১১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। তবে নোয়াখালী ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গত একমাসে

১৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫২ জন শিশু ও ৬৬ জন বৃদ্ধ। বেশিরভাগ মৃত্যু ঠাণ্ডাজনিত রোগে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নোয়াখালী প্রতিনিধির তথ্য অনুযায়ী, এখনো কয়েকশ রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছে। জানা গেছে, ডিসেম্বর মাসে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে ৯২৭ জন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৯৫০ জন রোগী ভর্তি হয়। এরমধ্যে মোট ১৪৪ জন মারা গেছে। যার মধ্যে শূন্য থেকে ৪ বছর বয়সি ৫১ জন, ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সি ১ জন, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি ৭ জন, ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ১৯ জন ও পঞ্চাশোর্ধ্ব ৬৬ জন মারা গেছে।

গতকাল হাসপাতালে গিয়ে জানা গেছে, গত সাত দিনে শিশু ওয়ার্ডে ১২৯ জন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১০৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে তিনজন রোগী মারা গেছেন। গত কয়েকদিন বেশির ভাগ রোগী ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স আকলিমা আক্তার বলেন, স্বল্প জনবল নিয়ে রোগীদের চাপ সামলাতে হচ্ছে। বার বার বলার পরও ডিউটি নার্সের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে না। রোগীরা একযোগে সেবা চাইলে একার পক্ষে একজন নার্স তা দিতে পারেন না। তাই কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হেলাল উদ্দিন জানান, ৫৭ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ৪৩ জন। নার্সসহ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরও চরম সংকট রয়েছে। ফলে রোগীদের অতিরিক্ত চাপে চিকিৎসা দিতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এদিকে শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুনের উষ্ণতা নিতে গিয়ে কোথাও কোথাও অগ্নিদগ্ধের ঘটনাও ঘটছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ জন। এদের মধ্যে একজনকে বার্ন ইউনিটে এবং বাকি ৪ জনকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. এম এ হামিদ পলাশ জানিয়েছেন, ৫ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। দগ্ধ ৫ জনের সবাই নারী।

সরকারি হাসপাতালগুলোর শিশু ওয়ার্ডে বেডের চেয়ে রোগী বেশি। বাধ্য হয়েই হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দাতেও রোগীরা থাকছে। চিকিৎসকরা বলছেন, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শিশুরা দ্রুত নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বর্তমানে যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, এর বড় অংশই আসছে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে। হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে গতকালও ১৬টি শিশু ভর্তি ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রায় সব ওয়ার্ডেই এখন ঠাণ্ডাজনিত রোগী ভর্তি করা হচ্ছে।

ঢামেক হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে প্রতি বছরই অক্টোবর থেকে জানুয়ারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ে। সম্প্রতি ঢামেক হাসপাতালে দৈনিক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ১০-১১ শিশু ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু শিশুর অবস্থা খুবই গুরুতর। কাজের অভিজ্ঞতা এবং কয়েকটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে যদি বলি তাহলে বলব, সাধারণত মা-বাবারা একেবারে শেষ মুহূর্তে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেসময় শিশুদের অক্সিজেন দেয়াসহ অন্যান্য জটিল চিকিৎসা দিতে হয়। আমি বলব, নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা মাত্রই বাবা-মা যেন শিশুটিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।

ঢাকার বাইরে চিত্র : নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, তীব্র শীত ও হিমেল হাওয়ায় ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আর এ কারণে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। এমন পরিস্থিতে শিশুদের বাড়তি যতœ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। গতকাল রবিবার নওগাঁ সদর হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত শিশুরা ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে। বেড সংকটের কারণে শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতেও অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স সেলিনা সুলতানা বলেন, তীব্র শীত ও ঠাণ্ডাজনিত কারণে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় অনেক শিশুকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এমনকি এক বেডে ২-৩ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ১২টি বেডের বিপরীতে ৫৭ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। তাদের সেবা দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

নওগাঁ সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. আবু আনছার আলী জানান, হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশি। তারপরও সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। কয়েক দিনে ৫৭ জন শিশু রোগী ভর্তি হয়েছে। শীত মৌসুমে শিশুরা নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর ও অ্যাজমায় বেশি আক্রান্ত হয়। শিশু অসুস্থ হলে মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে এবং নিয়মিত খাবার খাওয়াতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তার ঠাণ্ডা না লাগে। তাদের ধুলাবালি থেকেও দূরে রাখতে হবে। শিশু একটানা তিন দিনের বেশি অসুস্থ থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ফরিদপুর আলফাডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, হাড়কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা জনপদের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিশেষ করে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নাজমুল হাসান জানান, তীব্র শীতের কারণে হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে ভর্তি আছে। গত ৫ দিনে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা হাসপাতালে শিশুসহ শতাধিক রোগী ঠান্ডাজনিত কারণে হাসপাতালের বহির্বিভাবে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন তিনি।

বরগুনার পাথরঘাটা প্রতিনিধি জানান, গত বেশ কদিন ধরে পাথরঘাটাসহ দক্ষিণ উপকূলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিশু ও বয়স্কদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ঠাণ্ডাজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে নোমান নামের ২ বছর বয়সি এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুটি পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের হাঁড়িটানা নিবাসী মো. আসাদুজ্জামান আসাদের ছেলে।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল প্রতিনিধি জানায়, অসহনীয় শীতে কাবু ত্রিশালবাসী। কনকনে ঠাণ্ডা শীতে বাড়ছে শীতজনিত রোগ ব্যাধি। ব্যাহত হচ্ছে বুরো আবাদ। অসহনীয় শীতে কাদাপানিতে বোরোধান লাগাতে গিয়ে তীব্র শীতে অনেক কৃষক ঠাণ্ডাজনিত রোগ সর্দি কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App