×

জাতীয়

ই-বর্জ্যে অমিত সম্ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:১৩ এএম

ই-বর্জ্যে অমিত সম্ভাবনা

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন। অর্থাৎ বার্ষিক ২০ শতাংশের মতো উচ্চহারে বাড়ছে ই-বর্জ্য। অন্যদিকে স্বর্ণ, রুপা, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য দামি ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এর মধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে।

পরিবেশ-সম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে একটি মূল্যবান সম্পদে। ২০১৮ সালে সেন্টার ফর এনভায়রোমেন্টাল এন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (সিইআরএম) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) যৌথভাবে ই-বর্জ্য তৈরির পর্যালোচনা, বাংলাদেশে এর পরিবেশগত প্রভাব ও সম্পদ পুনরুদ্ধার সম্ভাবনা শীর্ষক বেজলাইন সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই গবেষণা এসব তথ্য জানানো হয়। বেজলাইন সমীক্ষাটি জানায়, ১ টন হ্যান্ডসেটে থাকে সাড়ে ৩ কেজি রুপা, ৩৪০ গ্রাম সোনা, ১৪০ গ্রাম প্যালাডিয়াম এবং ১৩০ কেজি তামা। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় ই-ওয়েস্ট সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, সবশেষ স্তরের ভোক্তা এবং এসব পণ্যের মেরামতকারীদের নিজস্ব খরচে ই-বর্জ্য অনুমোদিত হ্যান্ডলার (রিসাইক্লিং) প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, এরপর অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে এসব পণ্য খুলে বা পৃথক করে পরিবেশসম্মত উপায়ে রিসাইকেল করবে। তবে এই বিধির প্রয়োগ নেই সেভাবে। ই-বর্জ্যরে জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এটি সংগ্রহের চ্যানেলও নির্ধারণ করা হয়নি।

ফলে অনুনোমোদিত ভাঙারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং একইসঙ্গে অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনার ই-বর্জ্যরে ব্যবসা।

জানা গেছে, জে আর সলিউশন্সসহ বাংলাদেশের ৬টি কোম্পানি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লাইসেন্স পেয়েছে, যার আওতায় তারা সংগ্রহ করা আইটেমগুলো রপ্তানি করতে পারে। এদের মধ্যে ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স। কোম্পানিটি পুনরুদ্ধার করা আইটেম রপ্তানি করে। তাদের বেশিরভাগ রপ্তানিই হয় জাপান ও কাতারে। বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তবে দেশে যে বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে, তার সামান্য অংশ্যই সংগ্রহ করতে পারছে সনদপ্রাপ্ত ই-বর্জ্য রিসাইকেল কোম্পানিগুলো।

অপরদিকে এই বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভাঙারি ব্যবসায়ীরা। তারা সরাসরি চীনে স্ক্র্যাপ বা ভাঙারি হিসেবে রপ্তানি করে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১ এর শিথিল প্রয়োগই এজন্য দায়ী বলে মনে করেন সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি মালিকরা।

আন্তর্জাতিক কমপ্ল্যায়েন্সের আওতায়, বহুজাতিক টেলিকম অপারেটররা নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের ই-বর্জ্য দিলেও বেশিরভাগ সরকারি সংস্থা এক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন দরদাতা ভাঙারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না নিবন্ধিত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপক কোম্পানি। জে আর রিসাইক্লিং সলিউশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হোসেন বলেন, ভাঙারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহে সস্তা ও ত্রæটিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হয়। এছাড়া চীনে ই-বর্জ্য রপ্তানিতে তাদের যথাযথ নিবন্ধনের দরকারও হয় না। অন্যদিকে জাপানের মতো উন্নত দেশে রপ্তানি করতে হলে আগে সব ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে, পরিবেশগত সতর্কতা অবলম্বন করে এবং যথাযথ নিবন্ধনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম বিচ্ছিন্ন ও তা থেকে সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হয়। ২০১৮ সালের সিইআরএম-বুয়েটের সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ই-বর্জ্যে থাকে সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের (সিএফসি) মতো বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান। আরো থাকে পলিব্রোমিনেটেড ডিফাইনিল ইথার এবং পলিব্রোমিনেটেড বাইফেনিলের মতো অর্গানিক উপাদান, যা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ দূষণের কারণ হয়।

গবেষক দলের নেতৃত্বদানকারী ড. রওশন মমতাজ বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পরিবেশে রাখা হয় ই-বর্জ্য। এতে বৃষ্টির পানিতে টক্সিক কেমিক্যাল নিঃসৃত হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি থাকে। এসব রাসায়নিক প্রথমে মাটিকে দূষিত করে, তারপর ধুলার সঙ্গে পার্টিকেল ম্যাটার হিসেবে মিশে বাতাসকেও দূষিত করে। পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক এই বর্জ্যকে সম্ভাবনাময় ব্যবসায় পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্সের এমডি এম এ হোসেন।

সরকারের সঠিক পদক্ষেপের অভাব : পরিবেশসম্মতভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং এই ব্যবসার রপ্তানি সম্ভাবনাকে সুবিধা দিতে নিবন্ধিত ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের কাছে অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা বাস্তবায়নের অনুরোধ করে আসছে। ২০১১ সালে প্রথম খসড়া প্রস্তুতের পর এটি কার্যকর করতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায় সরকারের।

জানা যায়, এ নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কিছু উদ্বেগ থাকায় এই বিলম্ব হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিকারক বেশকিছু দেশ এই বিধিমালা বাস্তবায়ন অন্তত এক বছর পেছাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় লবিং করে। আমরা এসব পণ্য উৎপাদনের সময় সীসা ব্যবহারের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছিলাম সেটাও তারা কমাতে বলে।

এদিকে ৫ বছরের মধ্যেই দেশের অন্তত ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের। এর মধ্যে বিধিমালা বাস্তবায়নের এক বছরের মধ্যেই ১০ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপত্তির দিকগুলো নিরসন হলে, এই বিধিমালা দ্রুত বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে। তবে ২০২১ সালের ১০ জুনের পর এক বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ বিধিমালা অনুসারে এখনো নির্ধারণ করা হয়নি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যানেল। বিধিমালায় বলা হয়েছে, দেশের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট পক্ষ। তারা উৎপাদক, সবশেষ ভোক্তা ও রিসাইকেল প্রতিষ্ঠানের মধ্য সংযোগ সেতুর কাজ করতে পারেন। অথচ এ ব্যাপারে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে প্রায় অন্ধকারেই রয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App