×

অর্থনীতি

টালমাটাল অর্থনীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫৪ এএম

টালমাটাল অর্থনীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস
টালমাটাল অর্থনীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস

ফাইল ছবি

স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল জাগিয়েছে সম্ভাবনা

বছরের শুরুতে করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে জনজীবন, কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে অর্থনীতি। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা থমকে দাঁড়ায়। দেশের অর্থনীতি হয়ে ওঠে অস্থির। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ প্রভাব ফেলে আমদানি-রপ্তানিতে। যুদ্ধের ডামাডোলে চাল, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে চলতি বছরে। ডলার সংকটের অজুহাতে ভোক্তাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো দাম আদায় করেছেন ব্যবসায়ীরা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন বিষিয়ে তোলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। এরপরও নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্বপের পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন। এককথায় দেশের আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তা, বিপর্যয়, সংগ্রাম এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার বছর ২০২২। কেমন ছিল ২০২২ সালের অর্থনীতি?

সার্বিকভাবে, বেশ কয়েকটি কারণে দেশের অর্থনীতি চাপে ছিল। এর মধ্যে আছে ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকা, নজিরবিহীনভাবে ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়তে থাকা, পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, কর বনাম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত কমতে থাকা, নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দাম ও অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, একদিকে বহির্বিশ্ব থেকে অভিঘাত এসেছে, অন্যদিকে আমাদের নিজেদের নীতিগত দুর্বলতার কারণে অভিঘাতটা আরো বড় আকার ধারণ করেছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, টানা দুই বছর করোনা মহামারির নেতিবাচক অভিঘাত কাটিয়ে ২০২২ সালের শুরুটায় আর্থিক খাতের অবস্থান ছিল বেশ দৃঢ়। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা অর্থনীতি হঠাৎ করেই ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে টালমাটাল হয়ে পড়ে। এককথায় করোনার ছোবল থেকে অর্থনীতি উত্তরণের বার্তা নিয়ে যার শুরু, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে তা অনিশ্চয়তার বছরে পরিণত হয়। ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধের প্রভাব পড়ে আমদানি- রপ্তানিতে, অন্যদিকে বাজার গরম করে ভোজ্যতেলের দাম। মার্চ-এপ্রিলে দরপতন হয় ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে। ১২ কেজি একটি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৩৯ টাকায়, যা ২০২২ সালে সর্বোচ্চ। এরপর মে মাসে আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তেলের বাজার। এক লাফে ৩৮ টাকা বেড়ে ১৯৮ টাকায় পৌঁছায় প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম। তবে, সংকট আর সম্ভাবনাময় একটি মাস ছিল জুন। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরণ শত মানুষের প্রাণ কেড়েছে। জুলাই মাসের পর থেকে

হঠাৎ দেশে আলোচনায় রিজার্ভ, দুই বছর পর ৪০ বিলিয়নের নিচে নামে দেশের রিজার্ভ। এছাড়া আদমশুমারির ফল প্রকাশ, ফ্যামিলি কার্ডে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি।

এরপর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আবারো নাভিশ্বাস দ্রব্যমূল্যের বাজারে, ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ টাকায়, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কারসাজিতে জড়িত ৬ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, সংকটে পড়ে চিনির বাজার, রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানিতে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণ। সংকট কাটিয়ে নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ২৫ ডলার নিয়ে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের রেকর্ড করে দেশ। সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয় আইমএফ, দেশের বিমান খাতে ডানা মেলে নতুন এয়ার লাইন্স- এয়ার অ্যাস্ট্রা। অপেক্ষার শেষে ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি : রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। ফলে অর্থনৈতিক টানাপড়েন, খাদ্য সংকট এবং ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। জ্বালানি তেল এমন একটি পণ্য যার ব্যবহার কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সবক্ষেত্রে। বলা হচ্ছে ভর্তুকি কমাতে এবং পেট্রোবাংলার লোকসান কমাতে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের জন্য এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো বলছে আইএমএফ এমন কোনো শর্ত দেয়নি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

বাজার খরচ কমাতে কমাতেই বছর পার : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রপ্তানি আদেশে বাধা এবং জাহাজের ভাড়া বাড়ানোর অজুহাতে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও। ফলে খরচ মেটাতে মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। ২০২১ সালে করোনার কারণে অনেক বাড়িওয়ালা বাসাভাড়া না বাড়ালেও এ বছর অনেকে ভাড়া বাড়িয়েছেন। স্কুল-কলেজের বেতনের পাশাপাশি বেড়েছে খাতা-কলমের দামও। হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে নতুন চাপ সৃষ্টি হয়। সয়াবিন তেল ও চিনির দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানোর জন্য ভোক্তাদের এক প্রকার জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা। সরকার দাম বাড়ানোর ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখে পণ্যের সরবরাহ। অতি মুনাফার লোভে অবৈধভাবে সয়াবিন তেল মজুত করেন অনেক ব্যবসায়ী। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে বেরিয়ে আসে কারসাজি।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে গত ৩০ ডিসেম্বরের বাজারদর অনুযায়ী গত এক বছরে চালের দাম ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, খোলা আটা ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, প্যাকেট আটা ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ, সয়াবিন তেল লিটার প্রতি খোলা ২৫ দশমিক ৯০ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন ২১ দশমিক ৬১ শতাংশ, মসুর ডাল ২৫ শতাংশ, গুড়া দুধ ৩০-৪০ শতাংশ, চিনি ৪৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, লবণ ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও ডিমের দাম ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। টিসিবির তথ্য বলছে, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, মুগডাল, অ্যাংকার ডাল, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ ও ধনিয়ারও দাম বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সবজির দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় কেজি প্রতি কিছুটা বেড়েছে। কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। তবে গত এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছরজুড়েই বেশি । ব্রয়লার মুরগির দাম এখন বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি কেজি ১৫০ টাকার বেশি থাকে। করোনার আগেও এর দর ১৩০ টাকার আশপাশে থাকত। বিক্রেতাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, খাবারের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। তাই আর আগের দামে ফেরার আশা কম।

আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফিতির চাপ দেশেও : দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের কাছাকাছি। বাজারে গিয়ে ক্রেতারা স্বস্তি না পেলেও তিন মাস ধরে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি কমছে বলে জানিয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। অর্থাৎ ২০২১ সালের নভেম্বরে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন, বিদায়ী বছরের নভেম্বর মাসে একই পণ্য কিনতে খরচ হয়েছে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা। তার মানে এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা।

বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

যুদ্ধের ডামাডোলে বর্তমানে বিশ্বের ১০৪টি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিটের ওপরে। এর মধ্যে চারটি দেশে ১০০ ভাগের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে ওইসব দেশেও মূল্যস্ফীতির হার বেশি। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আগে ছিল ১ শতাংশের কম। এরপরেই ভারত থেকে বেশি আমদানি হয়। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। ফলে দেশে এ হারে চাপ বাড়ছে। নতুন বছর ওইসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরো বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এতে বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে কমেনি। উল্টো ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে এখন দাম আরো বেড়েছে। এদিকে চালের ভরা মৌসুমেও এর দাম না কমে বেড়েছে। অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। শীতের পরে পণ্যমূল্য আরো বাড়তে পারে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা, স্থায়িত্ব ও এর প্রভাব আগামী বছর বেশি বাড়বে। ফলে চালসহ খাদ্যপণ্যের উৎপাদন কমবে, বাড়বে দাম। এতেও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইএমএফের মতে, আগামী বছর বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ডলার ও রিজার্ভ সংকট : বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। ডলার সংকটে টালমাটাল অবস্থা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে রেমিট্যান্স। এতে আরো বেশি চাপ পড়েছে রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) দিন শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৮৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। এক বছর আগের একই দিনে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮০ কোটি ২২ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ১৯৬ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। রিজার্ভে টান পড়ায় সৃষ্টি হয় চরম ডলার সংকট। ৮৫ টাকার ডলার ওঠে ১২০ টাকায়। আমদানির ওপর কড়াকড়ি আরোপে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারার প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ে লাগামহীনভাবে। ৬ শতাংশ থেকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। দেশের খোলাবাজারে মার্কিন ডলার নিয়ে কারসাজি করায় পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ৪২টি মানি এক্সচেঞ্জকে শোকজ এবং ৯টি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়। এছাড়া মার্কিন ডলারের সংকটকে পুঁজি করে অনৈতিক সুবিধা নেয়ায় ৬টি ব্যাংকের এমডিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিলাসীপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি : আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বিলাসীপণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে বলা হয়।

বাণিজ্য ঘাটতি : একদিকে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫৮ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯১৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ঘাটতি বেড়েছে বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৩ টাকা ৮৫ পয়সা ধরে) ৪২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিতে চলতি হিসাবের ভারসাম্যও ঋণাত্মক হয়ে গেছে। কারণ, আমদানির তুলনায় রপ্তানি আয় কমলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে যায়। চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।

ব্যাংক খাতে অস্থিরতা : ২০২২ সালের শেষের দিকে ব্যাংক খাতের একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হয়। এতে ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা কমতে থাকে। এছাড়া ব্যাংকে টাকা নেই, এমন গুজবও ছড়ানো হয়। গুজবে কান দিয়ে অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন; যা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। তবে বছর শেষে এই প্রবণতা কমে এসেছে। অন্যদিকে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ে খেলাপি ঋণ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

প্রবাসী আয়ে ধস : চলতি (২০২২-২০২৩) অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা দুই বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স আসে দেশে। এর পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিনমাস দেড় বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে রেমিট্যান্স। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে) এ অর্থ ১৭ হাজর ৬৩ কোটি টাকার বেশি।

রাজস্ব আয় : চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬২০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ১ লাখ ২ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সংস্থাটির। একক মাস হিসেবে নভেম্বরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ২২ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হয়েছে রাজস্ব আদায়। নভেম্বরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ২৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম হয়েছে রাজস্ব আদায়।

আইএমএফের ঋণ : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেশ কয়েকটি দেশের অর্থনীতিতে মন্দা ও অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক দেশই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সহায়তা প্যাকেজ নিচ্ছে। ডলার সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। ডলারের সরবরাহ বাড়াতে সরকার আইএমএফের কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। আগামী জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ অনুমোদন হতে পারে। তখন প্রথম কিস্তিতে ৪৫ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে চলতি অর্থবছরেই বাজেট সহায়তার কিস্তি মিলতে পারে। ইতোমধ্যে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের বাজেট সহায়তার অর্থ পাওয়া গেছে।

সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি : অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বছরে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে সরকার। সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, অধিকাংশ সভা অনলাইনে আয়োজন করা, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। এছাড়া ছোটো-বড়সহ বেশকিছু প্রকল্পের কাজ স্থগিত করা হয়। ব্যয় সংকোচনের জন্য আপাতত ‘পদ্মা’ ও ‘মেঘনা’ নামে নতুন দুটি প্রশাসনিক বিভাগ করার সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে সরকার। এমনকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সম্মেলনেও এবার ৩০ লাখ টাকা ব্যয় কমানো হয়।

কম দামে টিসিবির পণ্য : ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে ২০ মার্চ থেকে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে সারাদেশে একযোগে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে একসঙ্গে দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা, দুই কেজি মসুর ডাল ও পাঁচ কেজি পেঁয়াজের প্যাকেট দেয়া হচ্ছে। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৬৫ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা দরে বিক্রি করছে টিসিবি।

প্রাপ্তির ঝুলিতে সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু : দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত বাঙালির বহু আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। যার দ্বার খুলেছে এ বছরের ২৫ জুন। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে বড় অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ২১টি জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। কংক্রিট আর ইস্পাতের কাঠামোয় পদ্মা নদীর দুই প্রান্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধও তৈরি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূত্রপাত। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে। শুরুর পর একদিনের জন্যও কাজ থেমে থাকেনি।

তবে এই সেতু শুধু একটি বড় অবকাঠামো নয়, এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি ‘মেগা’ প্রকল্প। এটি প্রমত্তা পদ্মার বুকে কারিগরি নানান জটিলতা কাটিয়ে নির্মাণ করা সেতু। বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ২১টি শিল্পনগরী রয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে আছে দুটি করে শিল্পনগরী। ২১ জেলার মধ্যে শিল্পনগরী নেই মাগুরা ও নড়াইল জেলায়। এই দুই জেলায় দুটিসহ মোট সাতটি নতুন শিল্পনগরী স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বিসিক। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২ হাজার ৪০০ একর জায়গায় এ শিল্পনগরী করার পরিকল্পনা বিসিকের। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব শিল্পনগরী বাস্তবায়ন করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে বলেও জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, এর মাধ্যমে ১০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

মেট্রোরেল যুগে দেশ : স্বপ্নের মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। যানজটের শহরে এই মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে জাদুর কাঠি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর চালু হয়েছে মেট্রোরেল। ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে এবং পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুতগামী, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সময়-সাশ্রয়ী, বিদ্যুৎচালিত, দূরনিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশবান্ধব অত্যাধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রবর্তন হিসেবে ২০১৬ সালের ২৬ জুন মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এক দশকের অপেক্ষার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। মূলত মেট্রোরেল নির্মাণ হবে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। এ জন্য ২০১২ সালের জুলাই মাসে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। যদিও পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়। ঢাকার বুকে এর প্রথম অংশ উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি) থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হয়েছে। এই পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। স্টেশন রয়েছে নয়টি।

দ্রুতগামী এই যোগাযোগ ব্যবস্থার (এমআরটি লাইন-৬) প্রাক্কলিত ব্যয় (দ্বিতীয় সংশোধিত) হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪১৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সহজ শর্তে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App