×

মুক্তচিন্তা

আওয়ামী লীগের সামনে চ্যালেঞ্জ কম নয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:২৩ এএম

রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সব সময়ই মুখোমুখি অবস্থানে থাকে। আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি বড় দল নাকি বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন বেশি- এই প্রশ্ন অনেকের মনেই আছে। দুই দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে, সে বিবেচনায় দুই দলই শাসক দলের দাবিদার। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা ও বিএনপির খালেদা জিয়াকে ১৫০-১৫০ আসনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব করে এরশাদকে ঘাবড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন বটে, তবে রাজনীতির একটি বড় ক্ষতি হয়েছিল। দুই দলের প্রধানকে সমান সংখ্যক আসনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেয়ার মধ্য দিয়ে কার্যত দুজনকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। এই রাজনৈতিক কৌশলের খেলার পরিণতিতে রাজনীতিতে ‘দুই নেত্রী’ শব্দটি চালু হয় এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমান গুরুত্ব পেয়ে যায়। তার আগে দুই নেত্রী বিষয়টি একসঙ্গে উচ্চারিত হতো না। আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালে। এর ২৯ বছর পর বিএনপির জন্ম। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল। এই দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের জন্ম মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের মধ্য থেকে। শাসকদের বিরোধী ছিল এই দলের প্রতিষ্ঠাকালীন অঙ্গীকার। বিএনপির জন্ম স্বাধীনতার পরে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক শাসক। বিএনপির জন্ম জিয়ার শাসনকে জনভিত্তি দেয়ার প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সাধারণ মানুষের স্বার্থ নয়, শাসকদের স্বার্থ রক্ষাই ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। বিএনপি যদিও জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন পেয়েছে, তবে সেটা জনস্বার্থের পক্ষের রাজনীতির কারণে যতটা, তার চেয়ে বেশি দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাবের কারণে। তারপরও সত্য এটাই, বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের সমর্থক সংখ্যা হয়তো বেশি, কিন্তু বিএনপিকে এককথায় নাকচ করে দেয়ার মতো নয়। এই দল জনগণের সমর্থন বা ভোটেও জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড তৈরি করেছে। বিএনপি ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকেও ২০২২ সালের শেষদিকে এসে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণে রাজনীতির মাঠ গরম হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে থেকে পরস্পর শক্তি পরীক্ষা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিকে আওয়ামী লীগ এতদিন যতটা দুর্বল ও গুরুত্বহীন ভাবলেও এখন মনে হয় আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে, বিএনপি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগকে একটু হলেও চাপে পড়তে হবে বৈকি! গত কয়েক বছর বিএনপি মাঠে না থাকায় আওয়ামী লীগ একচেটিয়া আধিপত্য দেখাতে পেরেছে রাজনীতির মাঠে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নড়াচড়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ প্রথমে তেমন পাত্তা না দিলেও বিভাগীয় সমাবেশগুলেতে বিএনপি জমায়েত বাড়াতে পারছে দেখে আওয়ামী লীগের টনক নড়েছে। প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠছে এবং বিএনপির এই চাঙ্গাকরণে আওয়ামী লীগও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিএনপি বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করে দল পুনর্গঠন ও দলের কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের সক্রিয় করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যেই ঢাকাসহ মোট ১০টি বিভাগীয় সমাবেশ সম্পন্ন করে বিএনপি তাদের শক্তির জানান দিয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটসহ বিভিন্ন উপায়ে বাধা দিয়ে মানুষের উপস্থিতি নিরুৎসাহিত করার সরকারি চেষ্টা সফল হয়নি। সমাবেশগুলোতে প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। বাধা দেয়ার সরকারি কৌশল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। হামলা-মামলার ভয় কাটিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা সাহসের পরিচয় দিয়েছে। এটা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগকে কার্যত রাজপথে শক্তি দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি। করোনার সংক্রমণ শুরুর (২০২০ সালের মার্চে) আগপর্যন্ত সরকার বড় কোনো সংকটেও পড়েনি। এই দীর্ঘ সময় বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল ঘরের ভেতরে, সংবাদ সম্মেলন ও সভা-সেমিনারে। এ বছরের শুরুর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতিতে সংকট বাড়তে থাকে। এর প্রভাবে দেশে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ-সংকট প্রকট হয়েছে। শিল্পকারখানায় গ্যাসের সংকট দেখা গেছে। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। মূলত জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-সংকট ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিএনপি মাঠের আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে। এবার বিএনপিকে মোকাবিলার জন্য আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশের উদ্যোগ নিতে হয়েছে। বিএনপির সমাবেশের শেষ কর্মসূচি ছিল ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। বলা হয়েছিল, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। সরকারের পক্ষ থেকেও পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, খেলা হবে ডিসেম্বরে। মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, ডিসেম্বর থেকে কি আবার সংঘাত-সহিংসতার রাজনীতি শুরু হবে? মানুষের জীবন এখন এমনিতেই সংকটগ্রস্ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ছে। মানুষের আয় বাড়ছে না। ব্যয় বাড়ছে। নতুন চাকরির ক্ষেত্র প্রসারিত না হয়ে বরং কলকারখানায় ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের সংকটে কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কলকারখানায় নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা না গেলে মালিকরা বাধ্য হবে কর্মী ছাঁটাই করতে। ফলে কর্মহীন ও উপার্জনহীন হওয়ার শঙ্কায় আছে অনেক শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষ। এরপর যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ে, তাহলে সেটা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। বাধা ও চাপের মধ্যেও বিএনপির সমাবেশগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কম না হওয়ায় এক ধরনের অস্বস্তি এবং চাপ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। আওয়ামী লীগও কয়েকটি বড় সমাবেশ করে এটা দেখাতে পেরেছে, সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন অটুট আছে। ১০ ডিসেম্বর নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে বিএনপি খুব সফল হতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার জেদ বজায় রাখতে পারেনি। সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে সমাবেশ করতে হয়েছে ছোট একটি মাঠে, যে মাঠে আগে কখনো কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কি ক্ষতি হতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করলে? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর বিএনপির কাছে আছে বলে মনে হয় না। সরকারের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ কয়েকজনকে কারাগারে যেতে হয়েছে। নতুন বছর শুরু হয়েছে গত বছরের রাজনীতির উত্তেজনার রেশ নিয়ে। এটা এখন পরিষ্কার, নির্বাচনের আগেই মাঠের শক্তি পরীক্ষায় দুই দলই জেতার চেষ্টা করবে। আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করছে, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, বিএনপির মূল লক্ষ্য সরকার পতন। যে কারণে রাজপথে সাংগঠনিক শক্তি দেখানো ছাড়া বিএনপির সামনে বিকল্প কিছু নেই। নির্বাচনের এত আগে মাঠে নেমে বড় জমায়েত করে বিএনপি দেশে-বিদেশে দেখানোর চেষ্টা করছে, তারা দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিএনপিকে এই শক্তি দেখানোর সুযোগ আর দেবে না সরকার ও আওয়ামী লীগ। আস্তে আস্তে দলটির ওপর চাপ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ হয়েছে, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। দলীয় নেতৃত্বে খুব একটা পরিবর্তন আনা হয়নি। পুরনো ও চেনা টিমমেটদের নিয়েই শেখ হাসিনা বিএনপির আন্দোলন ও নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক বক্তৃতায় এটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘যারা খুন, অগ্নিসন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত, তারা অনেকে লুকিয়ে ছিল, এখন বিএনপি মাঠে নেমেছে, তারাও মাঠে নামবে। এসব আসামিকে ধরতে হবে। তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। কারণ তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। জীবন্ত মানুষ হত্যা করেছে। চোখ-হাত কেটেছে, মানুষকে নির্যাতন করেছে। তাদের ছাড় নেই। আইন তার আপন গতিতে চলবে। আইন সবার জন্য সমান। এটা তাদের মাথায় রাখতে হবে। রাজনীতি করবে রাজনীতিক হিসেবে। কিন্তু সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী রাজনীতি এ দেশে চলবে না। এটা আমরা চলতে দেব না।’ বিএনপির যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, সে মামলাগুলো আবার নতুন করে সক্রিয় হলে বিএনপির নেতাকর্মীদের উৎসাহে ভাটা পড়ে কিনা, দেখার বিষয় সেটা। প্রধানমন্ত্রী দলের বৈঠকে বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি দলীয় নেতাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনে কঠিন প্রতিদ্ব›িদ্বতায় পড়তে হবে। তিনি এখন থেকেই সম্ভাব্য সেরা প্রার্থী বাছাই শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে আরো বলেছেন, দ্বাদশ নির্বাচনে শেখ হাসিনা পাস করাবেন এই ধারণা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। এবারের নির্বাচনে সবাইকে নিজের যোগ্যতায় জিতে আসতে হবে। দলীয় এমপিদের এলাকায় কার কি অবস্থা তা জানতে জরিপ চলছে। এমপিরা কর্মগুণে মনোনয়ন পাবেন। বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় জিতে আসে এমপিরা নির্বাচন কী তা বোঝেন না, তাদের বুঝতে হবে। বিএনপির সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দলের জন্যও সতর্কবার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হলে আওয়ামী লীগকেও যে বদলাতে হবে এটা কী আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মী বুঝতে পারছেন? যদি বুঝে থাকেন ও সে অনুযায়ী নিজেদের বদলাতে শুরু করেন, তাহলে ভালো। আগের ধারায় চললে এবং শেখ হাসিনা আছেন, তিনিই নৌকাকে জয়ের পথে নিয়ে যাবেন- এই বিশ্বাস নিয়ে বসে থাকলে পস্তাতে হবে। টানা তিন মেয়াদে দল ক্ষমতায় থাকায় যারা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন, তাদের জন্য লাল নোটিস দিয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ওই নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচনে হার-জিত আছে কিন্তু এমন শোচনীয় পরাজয় এত সফল সরকারের আমলে খুব স্বাভাবিক কি? বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App