×

মুক্তচিন্তা

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র জন্য সবার আগে যা প্রয়োজন…

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:২৬ এএম

স্মার্ট বাংলাদেশ মানেই আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার নয়। একজন মানুষ সে নারী কিংবা পুরুষ হোক না কেন তার সাজসজ্জা, পোশাক-আশাক, চলন-বলন, কথাবার্তা আধুনিক, ধোপদুরস্ত স্মার্ট হলেই তাকে পরিপূর্ণ স্মার্ট হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। যদি তার চিন্তাভাবনা, মন-মানসিকতা, রুচিবোধ, জীবনদর্শন, সৃজনশীলতা ইত্যাদি স্মার্ট না হয়, তাহলে তাকে কোনোভাবেই স্মার্ট মানুষ বলা যাবে না। এখানে স্মার্টনেস বলতে আমরা বুঝব পুরনো গতানুগতিক চিন্তাভাবনা, জীবনবোধ, মনমানসিকতা ঝেরে ফেলে কুসংস্কার, গোড়ামিমুক্ত মানবিক জীবনদর্শন অনুসরণ। ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এখনো অনেক পুরনো চিন্তাভাবনা, দর্শন, সংস্কার, ধ্যানধারণা জেঁকে বসে আছে। বাইরে থেকে দেখে যতই আধুনিক যুগোপযোগী মনে হোক না কেন ভেতরে ভেতরে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে লালিত চেতনা ও নীতিকে বহন করা হচ্ছে। যে কারণে এখনো সমাজে উপনিবেশিক প্রশাসনিক, বিধিবিধান, বিচারিক আইনকানুন, বাল্যবিয়ে, প্রাচীন রীতিনীতি ও সংস্কার অনুসরণ প্রতিনিয়ত চরম সংকট ও অস্বস্তির কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটলেও আজো গোটা শিক্ষাব্যবস্থা সময়োপযোগী স্মার্ট হতে পারেনি। প্রাচীন পদ্ধতির অনেক কিছুই অটুট রয়ে গেছে এখানে। গোড়ায় গলদ থাকায় অনেক কিছু পরিবর্তনের পরও শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের অচলায়তন পরিলক্ষিত হয়। একইভাবে প্রশাসনিক রাজনৈতিক চর্চায় অনেক আগে থেকে চলে আসা পুরনো ধ্যান-ধারণার ঘৃণ্য প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। সরকারি দপ্তর, কোর্ট-কাচারি, থানা, আদালত প্রভৃতিতে জনগণের প্রতি আন্তরিক মনোভাব নিয়ে সেবাদানের পরিবর্তে উপনিবেশিক প্রভুসুলভ মানসিকতা লালন করতে দেখা যায় বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে। যারা নতুন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে মুক্তচিন্তার চর্চা, আধুনিকমনস্কতা, সংস্কারমুক্ত হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করার আকাক্সক্ষা থাকলেও প্রচলিত প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থার কারণে নিজেদের সেভাবে বিকশিত করতে পারছেন না। নিজের মধ্যে লালন করা আধুনিক সংস্কারমুক্ত স্মার্ট চিন্তাচেতনা সবই বিসর্জন দিয়ে প্রচলিত ব্যবস্থার কাছে তাদের সমর্পণ করতে হচ্ছে। পরে একসময় তারা প্রচলিত সিস্টেমের গণ্ডিতে আবদ্ধ এক ধরনের রোবটে পরিণত হচ্ছেন। স্বাধীনতা লাভের পর ৫১ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাও মোটেও স্মার্ট হতে পারেনি। এখন আমাদের রাজনীতিকদের কেউ কেউ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, আবার কেউ রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলছেন উচ্চবিত্ত হয়ে। কিন্তু তারা কেউই নিজেদের বদলানোর কথা বলছেন না । তারা আদৌ নিজেদের বদলাতে চান কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫১ বছর। এই সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছি। মানুষের গড় আয়ু যেমন বেড়েছে, তেমনি মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বেড়েছে, নারীর ক্ষমতায়নও চোখে পড়ার মতো। এখন দেশের অনেক মানুষ তার মেধা ও শ্রম দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা কখনো ঘরের বাইরে আসেনি, তারা পোশাকশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশেও কাজের জন্য যাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষা লাভ করে তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরির পেছনে না ঘুরে গ্রামে গিয়ে আধুনিক কৃষি খামার করছেন। দেশের খাদ্য উৎপাদনে তারা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। আবার কেউ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হয়ে নতুন নতুন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করে কিংবা নিত্যনতুন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে চমক লাগানো সাফল্য অর্জন করছেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি, এই রাষ্ট্রের ভাগ্য যাদের হাতে ন্যস্ত যারা ৫১ বছর ধরে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের পরিচালনায় কাজ করে আসছেন তারা কেন জানি যথার্থ স্মার্ট হয়ে উঠতে পারছেন না। এখনো তারা দেশে সময়োপযোগী আধুনিক সময়ের স্মার্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা চালু করতে পারেননি। রাজনীতিতে তারা সুস্থ ধারা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রাজনীতিতে প্রতিদ্ব›িদ্বতা, প্রতিযোগিতা, বৈরিতা থাকবে। কিন্তু এখানে প্রতিদ্ব›িদ্বতা, প্রতিযোগিতা, বৈরিতা রাষ্ট্রের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব, দেশের মঙ্গলকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয় কোনোভাবেই। সরকারি, বিরোধী সব পক্ষকেই অবশ্যই দেশের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্মাণ করতে হবে। সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে দলে দলে পদ্ধতি ও নীতির কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব মতবিরোধ, নীতির ভিন্নতা কমিয়ে আনা উচিত। এক পক্ষ তার পরবর্তীতে অন্য পক্ষ ক্ষমতার কিছু অবদান রাখলে পরবর্তীতে অন্য পক্ষ ক্ষমতার পালাবদলে শাসনভার প্রাপ্ত হলে আগের সব কাজকে বন্ধ বা বাতিল করে আবার নতুন প্রকল্প কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে মনোযোগী হন। এটা আমরা দেখে আসছি স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে গত ৫১ বছরে। এ সংস্কৃতির লালন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। বাংলাদেশে অনেক কিছু বদলে গেছে। অ্যানালগ থেকে বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি পড়ে আছে আজো সেই সেকেলে অবস্থায়। আমাদের বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকরা একে অপরকে শত্রæ মনে করেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ তোলেন। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, অথচ বিরোধীপক্ষের গঠনমূলক সমালোচনাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না, কেউ সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, নীতি বিচ্যুতির সমালোচনা করলে তাকে নানাভাবেই হয়রানির শিকার হতে হয়। আবার সরকারের সব কাজের নানা অমূলক অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে সমালোচনা বিরোধী দলগুলোর এক ধরনের অসুস্থ প্রবণতা হিসেবে দেখে দেখে ক্লান্ত দেশের মানুষ। এ অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান প্রয়োজন স্মার্ট বাংলাদেশের স্বার্থে। মুখে মুখে গণতন্ত্রের বুলি ঝাড়লেও গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে সবকিছু রাজপথে ফয়সালা করার অপচেষ্টা দেশের আপামর জনসাধারণকে বিরক্ত এবং বিব্রত করছে বারবার। সবাই এ অবস্থার অবসান চায় মনেপ্রাণে। রাজনীতি মানে সংঘাত নয়। এখন সমঝোতা, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অতীতের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে উঠেছে যেভাবে, এখনো উঠছে সমানভাবে। পারস্পরিক সহনশীলতা, দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার মানসিকতা, স্বজনপ্রীতি, তোষণনীতি, দুর্নীতি-অনিয়মকে প্রশ্রয় না দেয়া, সব প্রকার সংকীর্ণ স্বার্থ ত্যাগ করে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সার্বিক উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। বর্তমানের অনেক কিছু ত্যাগ করার পাশাপাশি দুঃখকষ্ট সহ্য করার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে। এই উপমহাদেশে গত ১০০ বছরে কত সীমানা বদলেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে জাতি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আবার স্বৈরচারী সামরিক শাসনের কঠিন বেড়াজালে বন্দি হয়েছে। আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়েছে। স্বৈরাচার সামরিক শাসন বিদায় নিয়েছে। জনতার আন্দোলনের মুখে টিকতে পারেনি। এই সময়ে পৃথিবীটাও বদলেছে অনেক। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো বেশকিছু জায়গায় অনেক আগের মতো রয়ে গেছি। আমাদের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এখনো ১৯১৮ উপনিবেশিক কাঠামো বা ভাষার বাইরে বের হতে না পারার বিষয়টি বলা যায় এ প্রসঙ্গে। এত পালাবদলের পরও ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা সেই নিপীড়নমূলক আইনের স্পিরিট অব দ্য ল বা মূলভাবনা আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ, পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসনামল থেকে নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের যুগেও, কী ভাষায়, কী সংস্কৃতিতে- শাসক আর শাসিতের সেই পুরনো আমরা-তোমরা বাইনারি মেজাজেই রয়ে গেছে। এই সময়ের চ্যালেঞ্জটাকে আমলে না নিয়ে নির্বিকার বসে থাকার সুযোগ নেই- এটা উপলব্ধি করতে হবে সব পক্ষকেই। এখন ডিজিটাল বেনোজলে ভেসে যাচ্ছে গোটা দুনিয়া। অন্তর্জালের এই সময়ে ডিজিটাল নোম্যানস ল্যান্ডে মানুষের বসত। তাবৎ দুনিয়ার সিনেমা, টিভি সিরিজ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আজকের তরুণ-তরুণী। দেশি-বিদেশি নানা কনটেন্ট এখন ইচ্ছামতো তার মোবাইল ফোন সেট, টিভি, ল্যাপটপে দেখতে পারছে অবাধে। তার জন্য কোনো সার্টিফিকেট লাগছে না। ওটিটির বদৌলতে সারা দুনিয়ার বিনোদন সম্ভার ঘরে বসেই উপভোগ করতে পারছে। সিনেমা হল পর্যন্ত যাওয়া লাগছে না দর্শককে। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App