×

মুক্তচিন্তা

সব আন্দোলন যেমন আন্দোলন থাকে না, সব অভ্যুত্থানও গণঅভ্যুত্থান হয় না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:২৭ এএম

আমাদের দেশের রাজনৈতিক মহলে আন্দোলন, অভ্যুত্থান ও গণঅভ্যুত্থানের কথা বা হুমকি অতিশয় উচ্চারিত বিষয়। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সে রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেও ছিল। যেমন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাড়িয়ে ভারতবর্ষ দুটি দেশে বিভক্ত হয়। আমরা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনে যে ‘স্বাধীনতা’ লাভ করেছিলাম, সেটি আমাদের শেষ পর্যন্ত পরাধীনতাই দিয়েছিল। সে কারণেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অধিকার লাভের জন্য ২৩ বছর আমাদের বেশ কিছু আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই ইতিহাস সবারই জানা বিষয়। কিন্তু যে বিষয়টি বুঝতে হবে, তা হলো এসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক সংগঠন এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণে। কোনো কোনোটি ছাত্রদের নেতৃত্বেও। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত বেশ কিছু দল এবং গোষ্ঠী এসব আন্দোলনে যুক্ত ছিল না বরং বিরোধিতা করেছিল। সুতরাং রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যারা শুধু আদর্শগতভাবে জনগণের অধিকার লাভের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকেন, তারাই রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু যারা পূর্ব বাংলার জনগণের কোনো অধিকারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি- তারা ছিলেন জনবিরোধী, সুবিধাবাদী রক্ষণশীল এবং পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রতি নিঃশর্তবান। তাদের রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানিকরণের প্রতি বিশ্বস্ত রাখা। এই ধারার রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী এবং মানুষের সংখ্যা প্রথম দিকে যতটা সংহত ছিল, শেষ পর্যন্ত তারা তা থাকতে পারেনি। এর কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থা পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিতে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে চলছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্য থেকে ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদির পক্ষে অবস্থান নেয়ার মতো নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে। নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করার দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে থাকে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিছু তরুণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ পাকিস্তানের শুরু থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের হাত ধরেই পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত দল এবং রাজনীতি যাত্রা শুরু করে। পূর্ব বাংলায় এরাই পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার সংগঠন, আদর্শ, ত্যাগের ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ফলে এক-দেড় দশকের মধ্যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন যেমন কয়েকটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকাতেও কয়েকজনই রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের কাছে সমাদৃত হয়ে ওঠেন। আবার এই ধারার বিরুদ্ধেও সরকারি অনুগত পৃষ্ঠপোষক এবং পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রতি অন্ধ, অনুগত বেশ কিছু দল এবং তাদের নেতারা এসব আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সুতরাং সব রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র ও জনগণের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় এমন নয়। রাজনীতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী আবির্ভূত হয়। আবার পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব অধিকার লাভের রাজনৈতিক দল ও শক্তিরও অবস্থান ক্রমাগত আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই জনগণের মধ্যে পুষ্ট হতে থাকে। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত, আন্দোলন, দাবিনামা ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনীতির দুই ধারা যেমন প্রকাশিত হয়ে ওঠে, একইভাবে লড়াই সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জাতির স্বার্থের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সত্যিকার দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই শক্তি ৬ দফা দাবিনামা উত্থাপনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। পাকিস্তান সরকার এবং এর সমর্থক রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ৬ দফার বিরুদ্ধে বিকল্প প্রতারণামূলক ৮ দফা দাবি নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু‘ তাদের এই ‘রাজনীতি’ হালে পানি পায়নি। ‘আন্দোলন’ দাঁড় করানো যায়নি। ৬ দফার আন্দোলন জেলে থাকা বন্দি নেতাদের ত্যাগে আরো বেশি বলীয়ান হয়ে ওঠে। অবশেষে পাকিস্তানিরা যখন বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ওঠানোর ফাঁদ পাতে। তখনই পূর্ব বাংলার রাজনীতি শুধু নয়, সমাজ, জাতিগোষ্ঠী যেন এর বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে। খুব দ্রুতই আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ঐক্যবদ্ধ হয়। ছাত্র সংগঠন ১১ দফার ভিত্তিতে ৬ দফাকে জনগণের সম্মুখে তুলে নিয়ে আসে। শ্রমিক, কৃষক, শহুরে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ৬ দফা, ১১ দফা এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্র অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণকে যেখানেই বাধা দিতে গেছে, সেখানেই জনতার প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা জনতার এই ঐক্য ভাঙতে পারেনি। গ্রামের কৃষক, মজুর, নারী-পুরুষ জয় বাংলা স্লোগানে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান অকার্যকর করে দেয়। প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী গুলি চালিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু কোথাও মানুষ পিছু হটেনি বরং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আরো বেশি বেশি সংঘবদ্ধ হয়েছে। দাবি একটাই ছিল শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতেই হবে। অবস্থা এতখানি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, মুসলিম লীগের কোনো কোনো অংশ তাদের পূর্বের অবস্থান ত্যাগ করে ৬ দফা, ১১ দফা এবং শেখ মুজিবের মুক্তির পক্ষে বিবৃতি প্রদান করে তাদের অবস্থান জানান দেয়। কার্যত কোনো দল তখন প্রকাশ্যে পাকিস্তান সরকারের অবস্তানকে সমর্থন জানাতে স্বস্তিবোধ করেনি। পাকিস্তান থেকে দলে দলে নেতারা এসে পূর্ব বাংলার গণঅভ্যুত্থানকে বোঝার চেষ্টা করেছে, আইয়ুব খানকে তার অবস্থান ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, প্যারোলে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে আলোচনার বৈঠক ভেস্তে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে আইয়ুব খান মুক্তি দিতে বাধ্য হন। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসা শেখ মুজিব পরদিন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। পূর্ব বাংলা এবং পাকিস্তানের গোটা রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে বঙ্গবন্ধু আবির্ভূত হন জননন্দিত রাজনীতিবিদ হিসেবে। পালটে যেতে থাকে পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনীতি। এটিকেই বলে গণঅভ্যুত্থান। যে অভ্যুত্থানের পটভূমি রচিত হয়েছিল অনেক আগের ছোট ছোট আন্দোলন, দাবিনামা এবং জনগণের সম্পৃক্তার মধ্য দিয়ে। এখানে শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তের মানুষও যুক্ত হয়ে পড়েছিল। এর মূলে ছিল পূর্ব বাংলার জাতিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একাত্মতা, সচেতনতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা গড়ে ওঠা। এসব শর্ত পূরণ না করলে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান কিছুতেই হতো না। এই অভ্যুত্থান তৈরির পেছনের অভিজ্ঞতা এরকম ছিল না। নেতারাও সব এক মতের ছিল না। কিন্তু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন আপসহীন। এই আপসহীন নেতৃত্ব জেল এবং ফাঁসির কাষ্ঠে উঠতেও দ্বিধা করেননি। অন্যরা অনেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ’৬৮ এর শেষের দিকে ফিরে আসা শুরু হলো। ’৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান সবাইকে যেন কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। সে কারণেই পূর্ব বাংলা প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল গণঅভ্যুত্থানে। তাতে আইয়ুব খানেরই পতন ঘটল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল গণঅভ্যুত্থানকে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা, জাতীয়তাবাদ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি একনিষ্ঠ হওয়ার স্তরে উন্নীত করা, ধাপে ধাপে সেটিকে অগ্রসর করে পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অকার্যকর করা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকে ’৭০ এর নির্বাচন এবং ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে টেনে নিয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের গতি এভাবেই সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়। সেই দূরদর্শিতা প্রদর্শনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগীরা ছিলেন বলেই ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। একেই বলে গণঅভ্যুত্থানের রাজনীতি ও চূড়ান্ত অভিমুখীনতা। গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস এমনই বিস্তৃত, প্রখর, তীক্ষè এবং সুদূরপ্রসারী পরিণতিকে বক্ষে ধারণ করার বিষয়। সে কারণেই আমরা ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকে আমরা বারবার স্মরণ করি। কিন্তু‘ এই অভ্যুত্থানের মূল আদর্শের সঙ্গে কোনো কোনো দল এবং গোষ্ঠী যুক্ত ছিল না। তারা রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী যারা ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পরে জাতির আশা আকাক্সক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। সেটি করতে গিয়ে তারা গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছিল। সুতরাং রাজনীতির নানা শক্তি, অপশক্তি আন্দোলনে অংশ নেয়া এবং না নেয়া নানা গোষ্ঠীর স্বরূপ ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং তার পূর্ব ও পরবর্তীকালে দৃশ্যমান ছিল। সেসব অপশক্তি, ছদ্মাবরণধারী গোষ্ঠী স্বাধীনতা-উত্তরকালেও আমাদের রাজনীতির ডানে এবং বাঁয়ে ছায়ার মতো অবস্থান করে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে পারেনি। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো, পাকিস্তানকালের এবং স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্বকে এই সময়ে হত্যা করা হয়েছিল, নতুবা তাদের রাজনীতিকে কঠিন, জটিল এবং ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করেই এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক আন্দোলন, সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে- সেগুলোকে নিয়েই অনেকে গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু‘ ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস যারা জানেন, তারা পরবর্তী আন্দোলন ও ক্ষমতার পরিবর্তনকে কিছুতেই গণঅভ্যুত্থানের পরিণতি হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন না। এর কারণ হচ্ছে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক এবং অসাম্প্রদায়িক দলের নানা জোট, সমীকরণ ইত্যাদি ঘটেছে। কিন্তু‘ ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার বাইরে অবস্থানকারী উভয়েই ছিল সাম্প্রদায়িক, হঠকারী, সুবিধাবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী। ফলে সম্মিলিত আন্দোলনের ফলাফল সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতেই চলে গেছে। ‘৯০ এর আন্দোলনকে যারা গণঅভ্যুত্থান বলে দাবি করেন, তারা ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের কোনো চরিত্র, আদর্শ, জনসম্পৃক্ততা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন তাতে দেখার চেষ্টা করেন না। ’৯০ এর আন্দোলন ছিল সীমিত শহুরে মধ্যবিত্ত যুবক, তরুণ এবং রাজনীতির এক ভিন্নরূপ, যা গণতন্ত্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের শক্তিকে ধারণ করেনি। ফলে ’৯০ উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা বনাম অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতা বনাম স্বাধীনতাবিরোধিতা এবং সুবিধাবাদিতায় বিভাজিত হয়ে উঠেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এলেও অন্যরা তা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে চার দলীয় সাম্প্রদায়িক ঐক্যজোট তৈরি হয়। সেই জোট বাংলাদেশে ২০০১-০৬ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিনাশ ঘটাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। চেষ্টা হয়েছিল এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। কিন্তু‘ ২০০৭ সালে ক্ষমতা বেহাত হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পর গণতন্ত্রের ধারায় কিছুদিন চললেও সরকার উৎখাতের নানা ষড়যন্ত্র বারবার ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হয়েছে, কাক্সিক্ষত নির্বাচন বা গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াত ও নামসর্বস্ব ৩৩ দল যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। এই আন্দোলনে গোটা জাতির অন্তত অর্ধেক অংশ যুক্ত হবে না। কেননা এর মূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব হচ্ছে জামায়াত এবং বিএনপির, অন্য নাম সর্বস্ব দলগুলো তাদেরই ঘরানার। দেশের আপামর জনসাধারণ তাদের দাবি এবং আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরো বেশি বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে ফেলারই সম্ভাবনা দেখছে। কারণ অতীতে এরাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প রাজনীতিতে ছড়িয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের আসীন হওয়ার পরিণতি বাংলাদেশকে আধা-তালেবানি ধারাতেই নিয়ে যাবে। যেই আন্দোলন কিংবা তাদের ভাষায় গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রকে শেষ বিচারে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই আন্দোলন বা ‘গণঅভ্যুত্থান’ কখনো গণঅভ্যুত্থান হয় না, ইতিহাসের ভাষায় সেটাকে গণঅভ্যুত্থানবিরোধী ‘অভ্যুত্থান’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। গণঅভ্যুত্থানের গতি থাকে সম্মুখে, অভ্যুত্থানের গতি পেছনের দিকে। এই সত্যটি যারা এখন উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারা ইতিহাসের প্রতিবিপ্লবের পাঠ থেকে কিছুটা ধার নিতে পারেন, নতুবা যদি কোনোদিন ‘প্রতিবিপ্লবে’ তারা জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হন, তখনই তারা কেবল আজকের অভ্যুত্থানকারীদের প্রকৃত স্বরূপটি দেখতে পাবেন। বাংলাদেশে একবারই কেবল গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটি ১৯৬৯ এ। ’৯০ এ আধাসাম্প্রদায়িক, আধাগণতান্ত্রিক চরিত্রের নগরবাসীর আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল মাত্র, গণঅভ্যুত্থান নয় কোনো বিচারেই। ৩৩ দলের নেতৃত্বে এবার যদি কিছু হয়, সেটি আরো ভয়ংকর হবে। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App