×

অর্থনীতি

যুদ্ধকালেও বাংলাদেশের চমক, ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানির রেকর্ড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৫২ এএম

যুদ্ধকালেও বাংলাদেশের চমক, ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানির রেকর্ড

ফাইল ছবি

আশার আলো দেখছেন আরএমজি মালিকরা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে চমকের পর চমক দেখাচ্ছে। একক মাস হিসেবে ডিসেম্বরে রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য- যা গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে- যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। তবে এ পরিসংখ্যান অবাক করেছে আরএমজি মালিকরা। রপ্তানির এমন তথ্যে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে ৫৩৬ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা এক মাসের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়। যদিও চলতি বছরের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো রপ্তানি আয় ছাড়িয়েছিল ৫০০ কোটি ডলার। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। সে হিসাবে ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই মাসের চেয়ে বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যদিও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বর। ওই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৪২ কোটি ১০ লাখ ডলার।

আরো দেখা গেছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট ২ হাজার ৭৩১ কোটি ১২ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওই সময় পোশাক খাতে মোট রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ২৯৯ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ৯৬ লাখ ডলার ও ওভেন পোশাক রপ্তানিতে এসেছে ১ হাজার ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। ওলটপালট হয়ে গেছে সব হিসাব-নিকাশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নতুন বছরে মন্দা নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা। আইএমএফ জানায়, নতুন বছরেই মন্দার কবলে পড়বে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ দেশ। যার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে।

মন্দার আশঙ্কার কথা জানিয়ে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি গত বছরের তুলনায় এবার কঠিন সময় পার করবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থনীতির গতি এরই মধ্যে মন্থর হয়ে গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ এবং নতুন করে কোভিড দেখা দেয়ায় চীনের অনেক রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে আসছে। ভিয়েতনাম থেকেও কিছু অর্ডার আসছে। আর বাংলাদেশ কম দামি অতি প্রয়োজনীয় পোশাক বেশি রপ্তানি করে। সে কারণে আমেরিকা-ইউরোপের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলেও অতি প্রয়োজনীয় পোশাক তাদের কিনতেই হবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে। আইএমএফের প্রথম কিস্তির ঋণটাও ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংক-এডিবির বাজেট সহায়তাও দ্রুত পাওয়া

যাবে। সব মিলিয়ে রিজার্ভের ওপর আর চাপ থাকবে না। কোভিডের মতো এই সংকটও মোকাবিলা করতে পারবে বাংলাদেশ।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২২ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ আয় বেশি এসেছে। গত বছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। যার মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ- যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি।

রপ্তানির নতুন এ রেকর্ডকে ‘মিরাকল’ এবং ‘আশার আলো’ বলছেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, গত দুই মাসে রপ্তানির জন্য ক্রয়াদেশ কম থাকার পরও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ রপ্তানি হয়েছে, এটা শিল্প মালিকদের আশার আলো দেখাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা যারা রপ্তানিকারক তাদের বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, কাক্সিক্ষত রপ্তানি নেই, ক্রয়াদেশ নেই। বায়ারদের পেমেন্ট ঠিকমতো হচ্ছে না, বিশ্বমন্দার প্রভাব, অভ্যন্তরীণ গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা- এমন নানা সংকটেই আমরা কয়েক মাস আছি। যদিও গত মাসের ১০ তারিখের পর গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট কিছুটা কমেছে। সবকিছু নিয়েই আমরা এক কঠিন সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে রপ্তানির এমন তথ্য আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় অংকের রপ্তানি অতীতে কখনো হয়নি। রপ্তানি আয় বাড়লে দেশের ডলার সংকটও কেটে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের একটি আরএমজি রপ্তানিকারক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমার ব্যবসা জীবনের ইতিহাসে এখনই সবচেয়ে খারাপ সময় অতিবাহিত করছি। আমাদের প্রায় ৯০ শতাংশ কারখানাতেই ওভারটাইম চলছে না। এছাড়া অনেক কারখানা সাব-কন্টাক্টের জন্য ঘুরছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে রপ্তানিতে চমক দেখানোটা আমাদের জন্য বিস্ময়কর।

বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়ার পর পোশাক পণ্যের ইউনিট প্রতি দাম বেশি পাওয়ায় এবং উচ্চমানের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় ডিসেম্বরে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা গেছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে পোশাক প্রস্তুতকারকরা ৪০ ডলারের বেশি দামে একটি জ্যাকেট রপ্তানি করছেন, এর আগে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সাধারণত ৩০ ডলারের বেশি দামের জ্যাকেটের অর্ডার পেতেন না। নন-কটন আইটেম উৎপাদনে দেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এখন নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছেন। আর কটন বা তুলার তৈরি পোশাক পণ্যের চেয়ে নন-কটন আইটেমের দামও বেশি। ‘ম্যান মেইড’ বা কৃত্রিম তন্তুভিত্তিক এসব গার্মেন্ট আইটেমে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট ২ হাজার ৭৩১ কোটি ১২ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে- যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলা তৈরি পোশাক খাত ডিসেম্বরেও ভালো করেছে। গত ছয় মাস মিলিয়ে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর বাইরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছিল ৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।

পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪৮ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের- যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ৫৯ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। কৃষিপণ্য রপ্তানিও ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ কমেছে; এ খাত থেকে রপ্তানি হয়েছে ৫০ কোটি ১৯ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের ৬৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App