×

জাতীয়

বই সংকটে উৎসবে ছন্দপতন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম

বই সংকটে উৎসবে ছন্দপতন

ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হয় একটি-দুটি অথবা গতবছরের বই ফেব্রুয়ারির আগে সব শিক্ষার্থী বই পাবে না

শত শত শিক্ষার্থীর মুখে খুশির ঝিলিক। বছরের প্রথমদিন নতুন ক্লাসের নতুন বই হাতে পাওয়ার উচ্ছ্বাস। তবে মন খারাপও দেখা গেছে অনেকের। নতুন বইয়ের সুবাস পায়নি তারা। বইয়ের সংকটের কারণে ছন্দপতন ঘটেছে উৎসবের। সরকার ঘোষিত বই উৎসব নিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে গতকাল রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে, যেখানে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের নতুন বই সংগ্রহ করতে জড়ো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অপরদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক স্তরের বই উৎসব পালন করে গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সবাইকে নিয়ে বেলুন উড়িয়ে দিনের অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।

সেখানেও কেউ বই পেয়েছেন, কেউ পাননি। আবার যারা পেয়েছেন তারাও সবকটি বই পাননি। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের হাতে একটি বা দুটি বই ধরিয়ে দিয়ে সর্বজনীন এই উৎসব পালন করা হয়েছে। তবে দ্রুত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির আগে সব শিক্ষার্থী বই পাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বই নিতে আসা বানিয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র গৌরব সরকার বলেন, নতুন বই পেয়ে সত্যিই ভালো লাগল। এছাড়া আমি আমার কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছি…। মো. ইয়ামিন, তার সহপাঠী, কিছু বলতে খুব উত্তেজিত ছিল। তার হাতে নতুন বইয়ের সেট, মুখে হাসি। গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রিয়া বলেন, এই প্রথম আমি বই উৎসবে এসেছি। আমি যে নতুন বই পেয়েছি তা দেখুন…।

অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তক স্বল্পতার কারণে প্রাথমিক স্তরের কিছু শিক্ষার্থী বই পেলেও অনেকেই খালি হাতে উৎসবে অংশ নিয়েছেন। আবার যাদের বই দেয়া হয়েছে তাদের অনেকের হাতে অন্য শ্রেণির বই পাওয়া গেছে।

বছরের প্রথমদিনে নতুন বই না পাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষকরা। রাজধানীর দক্ষিণ মুহসেন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সাজিয়া ইসলাম।

এই ছাত্রী চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও তার হাতে দেয়া হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির বই। তিনি বলেন, এ বছর আমরা একটি বইও পাইনি। শিক্ষকরা জানান, নতুন বই না এলেও ক্লাসের সব শিক্ষার্থী উৎসবে অংশ নিয়েছে। আফসানা আক্তার মরিয়ম নামের আরেক ছাত্রী বলেন, এ বছর পঞ্চম শ্রেণি পাস করলেও নতুন বছরের বই না আসায় বই পাইনি। উৎসবে আসার জন্য আমাকে স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণির বই দেয়া হয়েছে। একই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী উম্মে কুলসুম আভা বলে, নতুন বছরে বই পাইনি। কেন পাইনি তাও জানি না। শিক্ষকরা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন, তাই এসেছি।

এদিকে নতুন পাঠ্যবইয়ের মান দেখে অভিভাবকরা খুশি নন। তানজিনা আক্তার নামে এক অভিভাবক বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের পাঠ্যবইয়ের মান তেমন ভালো নয়। শিক্ষার্থীদের সারা বছর তাদের বইয়ের যত্ন নেয়া উচিত। আরেক অভিভাবক রেহেনা বেগম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। আমি মনে করি এটি আমাদের পাঠ্যপুস্তকের মানকে প্রভাবিত করেছে। আশা করি আগামী কয়েক বছরে এই পরিস্থিতি থাকবে না। শিক্ষকরা জানান, ঢাকা মহানগরীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সব শ্রেণির বই পাঠানো হয়নি। সে কারণে কিছু শিক্ষার্থীকে বই ছাড়াই উৎসবে আনতে হয়েছে। দক্ষিণ মুহসেন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিলকিস আক্তার জানান, বিদ্যালয়ে এখনো সব বই পৌঁছায়নি। দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সব বই পাঠানো হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য বই পাওয়া যায়নি। সে কারণে শিক্ষার্থীদের বই দেয়া সম্ভব হয়নি।

বই উৎসব থেকে বঞ্চিত নারায়ণগঞ্জের ৪ উপজেলার শিক্ষার্থী 

সব শ্রেণির বই না আসায় নারায়ণগঞ্জের ৪টি উপজেলায় নতুন বই বিতরণ সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বই উৎসব ধরে রাখতে সদর উপজেলা থেকে বই ধার নিয়ে অন্যান্য উপজেলা সমন্বয় করছে বলে দাবি শিক্ষা অফিসের। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি উপজেলার প্রাথমিক বই ছাপার কাজ দেয়া হয়েছে মোট পাঁচটি ছাপাখানাকে। কিন্তু ছাপাখানা থেকে সময়মতো বই সরবরাহ করতে না পারায় নারায়ণগঞ্জের ৪টি উপজেলায় শিক্ষর্থীদের মধ্যে নতুন বই বিতরণ সম্ভব হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী রাফাজ আনান অহুতের মা রাজিয়া সুলতানা জানান, আজকে সব বই দেয়া হয়নি, শুধু বাংলা বই দেয়া হয়েছে। শুনেছি নারায়ণগঞ্জের সব উপজেলায় বই পৌঁছায়নি, তাই সদর উপজেলা থেকে বই ধার নিয়ে অন্য উপজেলার শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে। আদর্শ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, আমাদের চাহিদা অনুযায়ী শতভাগ বই পাইনি। যা বরাদ্দ এসেছে তা থেকে সমন্বয় করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (সাধারণ) মো. নুরুল হাসান বলেন, জেলায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য মোট পাঠ্যপুস্তক বরাদ্দ ছিল ১৫ লাখ ২১ হাজার ২৯৪ সেট বইয়ের। এর মধ্যে বই প্রাপ্তির সংখ্যা ৭ লাখ ৪ হাজার ৪১৮ সেট ও ঘাটতির পরিমাণ ৮ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৬ সেট। বরাদ্দ ও ঘাটতির হিসেবে প্রাপ্তির হার ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।

সুনামগঞ্জে হাওড়ের শিক্ষার্থীরা পায়নি বই : হাওড়ের জেলা সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় নতুন বছরে ধার করা বই দিয়ে পালন করা হয়েছে বই উৎসব। উপজেলাগুলো হলো- সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার। এ ৫ উপজেলায় কোনো বই পাঠাতে পারেনি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। উৎসব পালনের জন্য পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকে ধার করে বই আনা হয়েছে। যেসব উপজেলায় বই পৌঁছেছে সেখানেও প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অনেক বিষয়ের পাঠ্যবই হাতে পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। রবিবার সকালে শহরের সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক দিবস-২০২৩ এর শুভ সূচনা করেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মাকসুদ চৌধুরী।

এ সময় একে একে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় নতুন বই। আনুষ্ঠানিকভাবে জেলার অধিকাংশ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী বই পেলেও খালি হাতে ফিরেছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। পৌর শহরের নতুন পাড়ার বাসিন্দা শিশির তালুকদার বলেন, আজ নতুন বই দেবে, মেয়েকে নিয়ে এসে শুনি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো বই পৌঁছেনি এখনো। কবে আসবে তাও জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে এসেছিল, এখন খালি হাতেই বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। পারভীন বলেন, নতুন বই নেয়ার জন্য ছেলে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু সকালে বই নিতে এলে মাত্র একটি বই তার হাতে দেয়া হয়। বাকিগুলো পরে দেয়া হবে বলে বিদায় জানানো হয়। উৎসবের মধ্যে এমন হাতাশা আশা করিনি।

জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, যতটুুকু জানি দেশে কাগজ সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। যথাসময়ে বই ছাপতে দেরি হওয়ার কারণে আমাদের চাহিদামতো বই পাইনি। নতুন বছরে চাহিদার ৩৫ শতাংশ বই এসেছে সুনামগঞ্জে। এর মধ্যে পাঁচটি উপজেলার জন্য কোনো বই আসেনি। এসব উপজেলায় বই উৎসব পালনের জন্য অন্য উপজেলা থেকে বই আনা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো বই এখনো সুনামগঞ্জে আসেনি। বিষয়টি জানানো হয়েছে। আশা করছি চলতি মাসেই সব বই চলে আসবে।

দশমিনায় বই না পেয়ে ফিরে গেলেন ৮ হাজার শিক্ষার্থী

পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় দেড় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮ হাজার শিক্ষার্থী নতুন বছরে বই না পেয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে গেছে। এ ঘটনায় অভিভাবকরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রবিবার বছরের প্রথমদিন উপজেলার ১৪৫টি সরকারি ও ৬টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই নিতে বিদ্যালয়ে এলেও তারা খালি হাতে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে গেছে। দশমিনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিশা বলেন, বিদ্যালয়ে নতুন বই আনতে গিয়ে বই না পেয়ে মন খারাপ করে খালি হাতে বাড়ি ফিরে এসেছি। একই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সন্তানদের বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেননি তাদের বই দেয়া হবে না। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে বই না পেয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এসেছেন তারা।

১১৫ নম্বর পশ্চিম চরহোসনাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সুমন খান বলেন, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন বই এখনো পাওয়া যায়নি তাই বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। দশমিনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেরি সুলতানা বুলু বলেন, তার বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীকে নতুন বই বিতরণ করা সম্ভব হয়নি এবং ওই তিনটি শ্রেণির কোনো বই আমাদের সরবরাহ করা হয়নি। কবে নতুন বই পাওয়া যাবে এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকেও নির্দিষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আল মামুন বলেন, আমাদের কাছে এখনো তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোনো বই সরবরাহ করা হয়নি তাই বছরের প্রথমদিনে ৮ হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে বই বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। বই পাওয়া গেলে শিক্ষার্থীদের বই সরবরাহ করা হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে ভোরের কাগজের সুনামগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও দশমিনা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App