×

জাতীয়

ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনায় ভাটা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৪ পিএম

ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনায় ভাটা

ফাইল ছবি

গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট উৎপাদনে যেতে পারছে না এপিআই

এক সময়ের সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর ওষুধ শিল্প এখন শক্ত অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ নিজেরাই উৎপাদন করছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন মহাদেশের ১৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানিও হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ শিল্পের সম্প্রসারণে ৩টি পদক্ষেপ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এগুলো হলো- ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কপিরাইট আইন বা মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুযোগ এবং সরকারের নীতিসহায়তা।

সম্প্রতি এক সাক্ষৎকারে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এখন ওষুধ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বিদেশে। আমেরিকায় আমাদের বাজার আছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সুযোগ বাড়ছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, তবে এই অবস্থায় আসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ ছিল। ওষুধ নীতি প্রণয়ন বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। চিকিৎসকরা বড় ধরনের সমর্থন দিয়েছেন। ওষুধের দামের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি সরকারি সমর্থনের কথা বলতেই হবে। সরকার যখন একটি শোভন পরিবেশ তৈরি করে দেয়, তখন একটি শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। দেশের প্রয়োজন ও চাহিদার ৯৮ শতাংশ স্থানীয় ওষুধ শিল্পই পূরণ করছে। এটি অনেক বড় বিষয়, অনেক বড় অর্জন। সবাইকে তা স্বীকার করতেই হবে।

এরপরেও সম্ভাবনাময় এই খাতের আধুনিকায়ন ও মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ওষুধের কাঁচামালের বেশির ভাগ এখনো আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল উৎপাদনে সরকার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নির্মাণ করছে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) বা ওষুধ শিল্প পার্ক। নির্মাণকাজ প্রায় শেষ, তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদনে যেতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, ওষুধ শিল্প পার্ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণের কাজও শেষ। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ পেলেই আমরা উৎপাদনে যেতে পারি। ২০২৩ সালের প্রথম দিকেই পরিপূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারব বলে আশা করছি।

সম্প্রতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা ওষুধের শিল্পে নতুন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে দেশের অনেক ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে ধারাবাহিকভাবে কমছে এলসি খোলার হার। এলসি খুলতে না পারা ওষুধের কাঁচামাল আমদানি ও ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বলা হচ্ছে, মার্চ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু কাঁচামাল আমদানিতে সংকট দেখা দিলে এর একটি বড় প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এসব অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বছরে ২৪ হাজার রকমের ১২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করে।

দেশে কাঁচামাল উৎপাদনে বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে শফিউজ্জামান বলেন, চাইলেই উদ্যোক্তারা ইচ্ছামাফিক কাঁচামাল তৈরি করতে পারবে না। কে কী উৎপাদন করবে, তা জানাতে হবে। একটা কোম্পানি যে কাঁচামাল তৈরি করবে, তা যেন আরেকজন তৈরি না করে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। একই কাঁচামাল একাধিক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করলে আমাদের ক্ষতি হবে। দেশেরও ক্ষতি হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ ছাড়াও ওষুধ শিল্প খাতে রয়েছে আরো কিছু প্রতিবন্ধকতা। দক্ষ মানবসম্পদ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকা, রপ্তানি প্রক্রিয়ায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এ শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। এছাড়া বাংলাদেশের ওষুধ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেই স্বীকৃতি অর্জন করতে সমর্থ হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত সরকারি মান যাচাইকারী কোনো ল্যাবরেটরি নেই। এ ছাড়া অবৈধ দোকান, চোরাচালান ও নকল ওষুধের কারণে বাজারে নিম্নমানের ওষুধ মিলছে। এগুলো ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা।

শুধু তাই নয়, এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পাচ্ছে। যেমন- বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কপিরাইট আইন বা মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা, যার মেয়াদ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত দেয়া আছে। এই সুবিধার আওতায় ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে কোনো ধরনের ফি দিতে হয় না। এ কারণে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সস্তায় ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে। তবে সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। তখন এ সুবিধা আর থাকবে না। ওষুধের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়তে পারে ওষুধের দামের ওপর। এর ফলে ওষুধশিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তারা আরো বলছেন, এরই মধ্যে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। উত্তরণকালীন বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে বাংলাদেশের। বাজার-সুবিধা, কম সুদে ঋণসহ নানা বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেও ওষুধ শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না। কীভাবে সম্ভাবনাময় এই শিল্পের আরো বিকাশ করা যায় সে বিষয়ে সরকারকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App