×

জাতীয়

উৎসবে মিলবে না সব বই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:৪৭ এএম

উৎসবে মিলবে না সব বই

ফাইল ছবি

‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে/ফুলের মতো ফুটবো, বর্ণমালার গরব নিয়ে/আকাশজুড়ে উঠবো’- ২০১০ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবই উৎসব নিয়ে তৎকালীন শিক্ষা সচিব ও কবি কামাল চৌধুরী কবিতা লিখে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন। এরপর থেকে নতুন বছরের প্রথমদিনটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অন্যরকম এক আনন্দের দিন। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে বাড়ি ফেরা- একটা রেওয়াজে পরিণত হয়। কিন্তু করোনার থাবা এসে মলিন করে দেয় সেই রেওয়াজ এবং বই উৎসব।

গত দুই বছর শিক্ষাবর্ষের প্রথমদিন সব বই পৌঁছায়নি শিক্ষার্থীদের হাতে। পুরনো স্মৃতি ভুলে তারা আগামী বছরের শুরুতে সব নতুন বই পাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও এবারো তা পূরণ হচ্ছে না। কেননা বছরের প্রথমদিন কারো হাতে একটি, আবার কারো হাতে দুটি বই দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগামী রবিবার থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও এখনো বই ছাপার কাজ বাকি ৩০ শতাংশ। বাকি এই সময়ে সব বই ছাপার কাজ শেষ হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে এনসিটিবি ও মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা। এর ফলে বছরের প্রথমদিন সব বই হাতে না নিয়েই বিফল মনোরথে ফিরতে হবে শিক্ষার্থীদের। এদিকে বিনামূল্যে বই ছাপানোর এ বিষয়গুলো নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় মাউশি সচিবের নির্দেশে এনসিটিবির বিতরণ শাখার একাধিক কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়েছে। এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শোকজের কথা স্বীকার করলেও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

এ রকম পরিস্থিতিতে আগামীকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে বই উৎসবের উদ্বোধন করবেন। এদিন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী বই নেবে। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি মাধ্যমিক স্তরের বই উৎসব গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে প্রাথমিক স্তরের বই উৎসব পালন করবে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়। এসব উৎসবে শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।

পাঠ্যবইয়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গত বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বক্কর ছিদ্দিক এনসিটিবিতে গিয়ে বৈঠক করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে জানান, নানা সংকটে সব বই হয়তো শিক্ষার্থীরা পাবে না, তবে সবার হাতে বই পৌঁছাবে। আমরা মাধ্যমিকে অন্তত ৮০ শতাংশ বই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেব। বাকি বইগুলো ১৫-২০ জানুয়ারির মধ্যে সবার হাতে পৌঁছাবে। প্রাথমিকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই পৌঁছে দেব। নিম্নমানের বই ছাপা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ যদি খারাপ বই দেয় তাহলে তাকে

রিপ্লেস করতে হবে। আর যদি না করে তাহলে ডবল ফাইন দিতে হবে। এনসিটিবির (সদস্য) অধ্যাপক লুৎফুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এবারের বই উৎসবে হয়তো পুরো বই দেয়া যাবে না। তবে সব শিক্ষার্থীর হাতে যাতে একটি করে বই থাকে সেটি নিশ্চিত করা হবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় বড় ছাপাখানাগুলো সময়মতো বই ছাপিয়ে দিলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

জানা গেছে, বিলম্বে কার্যাদেশ, কম দরে কাজ নেয়া ও কাগজ সংকটের অজুহাতে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপছেন অধিকাংশ মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যেই নিম্নমানের বই ছাপার জন্য অন্তত ২০টি প্রকাশনা সংস্থাকে শোকজ করা হয়েছে। কাগজ বাতিল করা হয়েছে সাড়ে তিনশ মেট্রিক টন। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বই রিপ্লেস করতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ বইয়ে দরপত্রের শর্তানুযায়ী কাগজ ব্যবহার করা হয়নি। দেয়া হয়েছে হোয়াইট প্রিন্টের নামে নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট, যা মূলত রিসাইক্লিং কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি। এছাড়া বাঁধাইসহ আনুষঙ্গিক কাজও মানসম্মত নয়। এছাড়া বেশ কিছু ছাপাখানা সিন্ডিকেট করে বসে রয়েছে, আগামী জানুয়ারিতে কাগজের দর কমবে। এরপর তারা বই ছাপিয়ে দেবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এবারের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল সেটি নিরসনে মাস দেড়েক আগে সাবেক মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একটি সভা হয়। সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন। ওই সভায় মুখ্যসচিব সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, যেভাবেই হোক আগামী ১ জানুয়ারি দেশে পাঠ্যপুস্তক উৎসব পালিত হবে। এরপরই সিদ্ধান্ত হয়, ১ জানুয়ারি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মোট ৬টি বইয়ের পরিবর্তে ৩/৪টি বই এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে মোট ১০টি বইয়ের পরিবর্তে ৬/৭টি বই হলেও তুলে দেয়া হবে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে পাবে শিক্ষার্থীরা।

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এবারের পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে। কারণ কম দরে কাজ নেয়া, কাগজ সংকট, বিলম্বে কার্যাদেশ- এসব অজুহাতে মুদ্রণকারীরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপছে। এনসিটিবি চাইলেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আর কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান বেশি সংখ্যক কাজ পাওয়ায় এবার বেশি পরিমাণে নিম্নমানের বই ছাপা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে চলমান সংকট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও তারা অংশ নেয়নি।

এনসিটিবি কর্মকর্তারা আরো জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত বছরও কম দরে কাজ নিয়ে নিম্নমানের বই সরবরাহের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি এনসিটিবি। এবার এনসিটিবি নিম্নমানের বই ছাপা বন্ধ করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া মুদ্রণকারীরা ইচ্ছে করেই শেষ মুহূর্তে বই সরবরাহ করেন যাতে এনসিটিবির হাতে কোনো উপায় না থাকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App