×

মুক্তচিন্তা

স্বাধীন সুন্দরী ও বাবা শহীদ জামালের স্বীকৃতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:৫৭ এএম

স্বাধীন সুন্দরী নামে একজন ছাত্রীর নাম শুনেছিলাম সেই ৩০ বছর আগে। সেই ছাত্রীকে আমি এর আগে দেখিনি কোনো দিন। শুধু জেনেছি, মেয়েটির বাবা যখন নিহত হন তখন মেয়েটি পৃথিবীর আলোই দেখেনি। তার বাবার নাম ছিল জামাল। একাত্তরের যুদ্ধ যখন চলছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদান-প্রদানকারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি, যে কথাটি চাউর হয়েছিল সে সময় এবং জামালকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কারেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল পাকহানাদারদের পক্ষ থেকে। রাজাকাররাই তাকে ধরিয়ে দেয় এবং বিয়ানীবাজারের এক বধ্যভূমিতে তাকে জীবন দিতে হয়। স্বাধীন দেশের সূর্য ওঠে, লাখ লাখ জামালের রক্ত-ত্যাগে। আর সেই সঙ্গে জন্ম হয় এক ফুটফুটে সন্তানের, জামালের সন্তান, এক সূর্য-সেনার সন্তান। বিস্ময় লাগানো নামটি দেয় তার পরিবার- স্বাধীন সুন্দরী। মায়ের আদরে বড় হয়ে ওঠেন পিতৃহারা সুন্দরী, কলেজের চত্বরে তিনি ছাত্ররাজনীতির এক কর্মীও ছিলেন একসময়। কিন্তু এ অঙ্গনের কোনো সুন্দর স্মৃতি নেই স্বাধীন সুন্দরীর। অথচ আমাদের বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটা অর্জনে লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের যে গৌরবময় ইতিহাস, সেই ইতিহাসের একটা অংশ তার বাবা। স্বাভাবিকভাবেই সুন্দরী তার বাবার সেই অহংকার সঙ্গে নিয়েই বেড়ে উঠেছেন বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া ছাড়াই। তার বাবার গল্প শোনে শোনে অশ্রæ গড়িয়ে পড়েছে তার জীবনের বাঁকে বাঁকে। তার জীবনে বাবার কোনো স্মৃতি নেই, আছে শুধু রোদনে ভরা এক নদী দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাস আর পাড়া-পড়শীর গল্পে গল্পেই তিনি কল্পলোকে একজন বাবা দেখেছেন, দেখেছেন স্বামীহারা স্নেহময়ী এক মায়ের করুণ মুখ। মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হেলাফেলা দেখেছি আমরা একসময় আবার এ সময়ে এসে দেখছি সেই একাত্তরকে বাঙালি মানসপটে চিরজাগরূক রাখতে রাষ্ট্রীয় আয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এ সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় ভাতা কিংবা তাদের পরিবারদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটা বিশেষ অধ্যায় হিসেবেই আগামীর ইতিহাসে স্থান পাবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণীত হওয়ার পর দেখা গেছে সে সময়ের অনেক শিশুর নামও এসে গেছে ওই তালিকায়। স্থানীয় রাজনীতির নোংরামির কারণেই এটা হচ্ছে। অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের নামই আসছে না তালিকায়। আর সেজন্য এ সমালোচনার দায়ভার নিতে হচ্ছে সরকারকেই। স্বাধীনতার ধারক এ সরকারের আমলে সুন্দরী আশায় বুক বেঁধেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তিনি খুঁজে ফিরেছেন তার কল্পনায় বীরবেশে থাকা বাবার নাম। কিন্তু যুগের পর যুগ যায়, তার বাবার নামটা আর দেখতে পান না তিনি সেই তালিকায়। অথচ বিয়ানীবাজারের সড়ক ভাংনি নামের ব্রিজটি যখন ভাঙেন মুক্তিসেনারা, রাজাকার কিংবা পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের সব তথ্য প্রদান করেন ওই জামাল। ওই এলাকায় কখন কী ঘটতে যাচ্ছে, রাতের আঁধারে মুক্তিসেনারা তার বাড়িতেও আসতেন, নিয়ে যেতেন অনেক তথ্য, যে কথাগুলো বলেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রæর সঙ্গে বীরদর্পে লড়াই করা আরেক যোদ্ধা সিপিবির সিলেট জেলা শাখার সাবেক সভাপতি এডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য। ক’জন মুক্তিযোদ্ধার নামে বাংলাদেশে স্মৃতিসৌধ আছে আমি তার হিসাব জানি না, তবে এলাকার এই সূর্য-সন্তানকে স্মরণে রাখতে একজন জামালের নামে আছে শহীদ জামাল স্মৃতিসৌধ। আরো বিস্ময় জাগানো ইতিহাস হলো, এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই, ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর তারিখটা লেখা আছে এখনো সৌধেই। সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (আব্দুল্লাপুর) সামনে নির্মিত এই শহীদ জামাল স্মৃতিসৌধটি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। প্রতিটি বিজয়ের মাসে এ সৌধকে সাজানো হয়। স্মরণ করা হয় শহীদ জামালকে মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ হিসেবেই। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এলাকার মানুষের শত-সহস্র চিৎকারেও শহীদ জামাল মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তিনি স্থান পাননি। মুক্তির জন্য লড়াইয়ে থাকে শত-সহস্র মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা, একটা স্বাধীন দেশ অপশক্তির হাত থেকে ছিনিয়ে আনতেও লেগেছে জাতীয়তাবাদের উদ্বুদ্ধ আপামর মানুষের ত্যাগ ও বিসর্জন। এই ত্যাগের প্রথম সারির মানুষগুলো হলো তারাই, হয়তো যারা সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছেন কিংবা গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাদের বিসর্জনটাই মূলত আমাদের বিজয়ী করেছে, একটা দেশ দিয়েছে। এ যুদ্ধ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর ডাক এসেছিল, মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নির্দেশনায় এ যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। এভাবেই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে যুদ্ধের মাঠে বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে যারা গোপনে কাজ করেছে তারাও তো সমান ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেছে। এবং তাই রাষ্ট্রীয়ভাবেও এটা উচ্চারিত হয়েছে যে, যারা এই কাজগুলো করেছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। আর সেজন্যই যুদ্ধের ময়দানে যারা ভারতে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন কিংবা পত্রিকা বের করেছেন, তারাও মুক্তিযুদ্ধের খাতায় স্থান পেয়েছেন। এভাবেই যারা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিংবা বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন, তাদেরও এই সারিতেই রাখছে সরকার। আর সে হিসেবে শহীদ জামালেরাও প্রকৃত যোদ্ধা, যারা জীবনবাজি রেখেই এ কাজগুলো করেছিলেন। সত্যি কথা হলো জামাল জানবাজি রেখে শেষ পর্যন্ত জীবনটা বিসর্জনই করে দিলেন। কিন্তু ৫১ বছরে পূর্তিতেও এসেও শহীদ জামালের কন্যা স্বাধীন সুন্দরীর সেই বুকফাটা হাহাকার, তার বাবার শুধু একটা স্বীকৃতি। সূর্যালোকের মতো সত্য একজন জামালের আত্মত্যাগের কথা- তার নামে শহীদ জামাল স্মৃতি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এলাকার গর্বের এক ইতিহাস হয়ে, অথচ শহীদ জামালের স্বীকৃতি নেই। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সামনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এ ব্যর্থতা কার- রাষ্ট্রের না স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত মানুষগুলোর। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে দেশের সব জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই এ প্রভাবটুকু আছে বিয়ানীবাজার থানা অর্থাৎ উপজেলায়ও। এখানে দলের প্রভাবশালী নেতারা আছেন। এই দলটির কারো কারো নাম মাঝে মাঝে উচ্চারিত হয়, যারা কিংবা যাদের পূর্বপ্রজন্মের কেউ কেউ তৎকালীন দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গেই ছিলেন এবং এ কথাগুলো যতটুকু উচ্চারিত হয় তাদের দলের বাইরের মানুষের কাছ থেকে, তার চেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় দলের অভ্যন্তরেই। অর্থাৎ দলের নেতৃত্ব যখন এক পক্ষের বাইরে চলে যায়, তখন এই কথাগুলো জোরালোভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। আর এখানেই স্বাধীন সুন্দরীর বাবা জামাল আটকে আছেন। যখনই জামালকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি ওঠে, তখনই ক্ষমতাসীন দলে একটা কাঁপন ওঠে, অথচ লন্ডনভিত্তিক একটা অনলাইন মিডিয়ায় লাইভে এসে জামালকে ধরে নেয়ার পেছনে একজন রাজাকারের সরাসরি হাত আছে বলে শহীদ জামালের মা ওই রাজাকারের নাম বলেছেন, যিনি ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং রাজাকার হিসেবেই মারা গেছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের কারো নাম নেই। কিন্তু তারপরও কেন ওই জামালের নাম নিতে ভয় পায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ? জামালকে কে ধরিয়েছিল, সেটাতো মীমাংসিত। খবরের পেছনের খবর আছে জানি। কিন্তু এ নিয়ে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর কারণে কেনই বা একজন শহীদের ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে। কেনই বা অর্ধশতাব্দীকাল পেরিয়েও একজন শহীদ তার প্রকৃত সম্মানটুকু পাবেন না। এ প্রশ্নটা স্বাধীনতার চেতনার ধারক সরকার এবং দলটি এড়িয়ে যেতে পারে না। স্বাধীন সুন্দরীর মাও পৃথিবীতে নেই, শহীদ জামালের মাও মারা গেছেন একটা চাপা আর্তনাদ নিয়ে কিন্তু একজন স্বাধীন সুন্দরী কি তার বাবার মর্যাদাটুকু দেখতে পাবেন না তার জীবদ্দশায়? ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App