×

মুক্তচিন্তা

২০২৩ সালে দেশের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:৪৫ এএম

দেশের ১৭ কোটি মানুষ ২০২৩-এর বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির ভাবনায় সংশয়, সন্দেহ ও আতঙ্কের মধ্যে দিন গুনছে। ইতোমধ্যে আমরা প্রায় ২০২২ সাল অতিক্রম করে ফেলছি। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর একটি নতুন বছরের সূচনা পর্ব দেখতে পাব। আমরা ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার কাতারে আছি, যা জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তবে ২০২৬ সালে এ মর্যাদার পরিপূর্ণতা লাভ করা সম্ভব হবে। তবে সেটা কোনো সহজ কথা নয়। এ পথে আছে নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যেই যুদ্ধবিগ্রহসহ নানা সংকট আবর্তিত হয়েছে বিশ্ব। অর্থনৈতিক মহামন্দা পৃথিবীকে গ্রাস করবে এমনটাই বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকব। পাশাপাশি কলুষিত পরিবেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়ে আমাদের উদীয়মান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্রমাবনতির দিকে নিয়ে যাবে। কাজেই এ বাস্তবতায় ২০২৩ সালকে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, সুষ্ঠু অভিবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন, পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ ও বসবাসের নিশ্চয়তাসহ সামাজিক সুরক্ষার প্রতি আমাদের যতœবান হতে হবে। কেউ বলছে মন্দার সূচনা হবে ২০২৩ সাল থেকে আমরা কেউ কেউ বলছে ২০২৪ সালে বিশ্ব মন্দা প্রকট আকার ধারণ করবে। যাই হোক প্রকৃতপক্ষে যদি বিশ্ব মন্দা আমাদের আঘাত হানে সেক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের এ পর্যন্ত অর্জিত অগ্রযাত্রার এক বিশাল ছন্দপতন হবে। ২০২৩ সাল বাংলাদেশের জন্য হবে একটি বিশেষ বছর। ২০২২ সালে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়েছে, চলবে ট্রেনও। একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে ততদিনে। এ টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। ফলে ২০২৩ সালে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। স্বপ্নের এ তিন মেগা প্রকল্প নিয়ে দেশের মানুষের অনেক আশা, উৎসাহ, উদ্দীপনা। এগুলো শুধু অগ্রগতির প্রতীক হয়ে উঠবে না, এর সুফল দেশের অর্থনীতিতেও নতুন এক গতি নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির দিগন্ত বদলে যাবে। এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। সেই সঙ্গে এগুলো বাড়িয়ে দেবে দেশের মনোবল। ‘বাংলাদেশও পারে’ এমন সাহস সঞ্চার হবে মানুষের মধ্যে। এক ভিন্ন বাংলাদেশের উদয় হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর আগেই মহামারির ধকল সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আগে উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সে অবস্থায় ফিরে যাবে। আগের মতো ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। বড় ধরনের কোনো দৈবদুর্বিপাক দেখা না দিলে কয়েক বছরের মধ্যে প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়াবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু সংকট মোকাবিলায় তার ভাষণে করণীয় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এক নম্বর হলো- দুর্নীতিবাজ খতম করা, দুই নম্বর হলো- কলকারখানা ক্ষেতে-খামারে প্রোডাকশন বাড়ানো, তিন নম্বর হলো- পপুলেশন প্ল্যানিং, চার নম্বর হলো- জাতীয় ঐক্য। আজো বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এ চারটি কর্ম গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫১ বছর পর পেছন ফিরে তাকালে অনেক অর্জন আমাদের আশান্বিত করবে। কিন্তু তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এখনো জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি হীন ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় সংকীর্ণতায়। আমাদের জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা আমরা ৫১ বছরেও সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি। চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে বটে। কিন্তু গরিব মানুষের চিকিৎসা দেয়ার সংকুচিত সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত নয়, চিকিৎসকদের অধিকাংশই অর্থলিপ্সায় মগ্ন, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে তারা অধিক আগ্রহী। এ সংকট নিরসনের কথা ভাবতেই হবে। বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে গরিব মানুষের কল্যাণে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু শিক্ষা এখন বাণিজ্য। শিক্ষাকে মানসম্পন্ন করতে হবে। দুর্নীতির কারণে অর্থ-সম্পদে ধনী হলেও একটি জাতি সমৃদ্ধশালী হয় না। আমাদের শিক্ষার গলদ তথা উগ্র ভোগবাদী মূল্যবোধ থেকে বের হতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের পথ রচনা করতেই হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হিসেবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত এই মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আগামী বছর হবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে খারাপ সময়। আর আমাদের দেশে এই মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন, যেমন দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি, দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ী হওয়া এবং রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া। মূলত এসবই মন্দা মোকাবিলার জন্য এ মুহূর্তে সর্বোৎকৃষ্ট পদক্ষেপ এবং সে কারণেই এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে এখন থেকেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারা যত দ্রুত এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ততই আগামী বছরের আশঙ্কার মন্দা মোকাবিলার কাজটি অনেক সহজ হবে। দীর্ঘ পরিসরে চলা করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব ও ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানাবিধ কারণেই সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি মন্দার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। জ্বালানি সংকটের কারণে কৃষি উপকরণের দাম বাড়বে। এতে কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। জানা গেছে, উন্নত দেশগুলো চলতি বছর থেকেই মুদ্রার প্রবাহ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আগামী বছর এর প্রভাব আরো প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা আরো বাধাগ্রস্ত হলে মন্দা আরো প্রকট হবে। এছাড়া বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্যপণ্যের দাম। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিলে আমদানি করা পণ্যগুলোর দাম বাড়বে। সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে যদি দেশের সার্বিক রপ্তানি আয় কমে আর আমদানি আয় বেড় যায় তাহলে চলতি বছরের মতো আবারো ডলার সংকট তৈরি হতে পারে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে উঠতে পারে জাতীয় অর্থনীতি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, বিশ্ব এক অনাকাক্সিক্ষত মন্দার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই চাপ অনেকটা সামাল দিতে পারলেও সমস্যা সৃষ্টি বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের বেশি বেশি খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল আমদানি বন্ধ করে রপ্তানি আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হলে সম্ভাব্য মন্দার নেতিবাচক প্রভাব কোনোভাবেই মোকাবিলা করা যাবে না। আর এ দায়িত্বটা সরকারেরই বেশি। প্রধানমন্ত্রী স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের আওতায় স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তিনি সবাইকে খালি জায়গায় খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যাদি উৎপাদনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই আহ্বান অত্যন্ত যৌক্তিক। এটি বাস্তবায়নে অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনকে নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণকে নিয়ে কাজ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ডাটাবেজ তৈরি করে যারা বেকার রয়েছেন তাদের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির ন্যায্যতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি দুর্নীতিমুক্তভাবে চালু করতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয় প্রক্রিয়ায় সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। কৃষি, খাদ্য এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে দেশের জনগণের চাহিদা অনুপাতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ইতোমধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, জাপান ও চীন ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে বার্ষিক ভিত্তিতে প্রকৃত মোট দেশজ উৎপাদন ৬ দশমিক ২ শতাংশ ২০২১ সাল থেকে হ্রাস পেয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে ২০২২ সালে এবং ২০২৩ সালে হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক কাঠামো ও পরিবেশ ভিন্ন কিন্তু গুটিকয়েক দেশ ছাড়া অন্য সব দেশই মন্দার থাবা থেকে বেরোতে পারবে না। ইতোমধ্যে ইউরোপে যে উচ্চমূল্যস্ফীতি ঘটছে, মধ্যপ্রাচ্যে মূল্যস্ফীতির হার অধিক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতির উচ্চহারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এদেশে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আছেন যারা সিন্ডিকেট ও কার্টেল করে পণ্যের দাম বিভিন্ন সময়ে বাড়াচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ২০২৩ সাল আশীর্বাদ নাকি অভিশাপের? ২০২৩ সালে দেশের মানুষের আশা ও প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে? ২০২৩ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কতটা সফল হবে? ২০২৩ সালে বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত? ওপরের প্রশ্নের আলোকে আমাদের অভিমত এই যে, আগামীর বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা করা ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীও প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আগামীর বাংলাদেশ সম্ভাবনা ও স্বপ্ন পূরণের এক মহা অঙ্গীকার। শতাব্দীর অঙ্গীকার পূরণে সম্ভাবনাময় ও স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের মহান ব্রতে আগামী তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য এখন থেকেই বাস্তবায়নযোগ্য সব কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি হাতে নিয়ে তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ, পরিবিক্ষণ ও মনিটরিং রূপরেখা প্রস্তুত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যে ২০২৫ সালকে ধাপ-১ হিসেবে এবং ২০৩৫ সাল ধাপ-২ হিসেবে বিবেচনায় এনে মূল্যায়ন ও কার্যপত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে এ অভিমত প্রকাশ করছি যে, আগামী বাংলাদেশ হোক সম্ভাবনা ও স্বপ্নপূরণের, আশা ও আকাক্সক্ষার উচ্ছ¡াসে ভরপুর। আগামী ২০২৩ ও তার পরবর্তী সব কার্যক্রম হোক ইতিবাচক এবং উন্নত, সমৃদ্ধ স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের সোপান। তাহলেই জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে এবং বাংলাদেশ হবে মর্যাদা, গৌরবের ও সৌরভের। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App