×

মুক্তচিন্তা

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বিএনপির মেরামতের রূপরেখা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:৪৬ এএম

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বিএনপির মেরামতের রূপরেখা
উন্নয়নের সমার্থক শব্দ কি মেরামত হতে পারে? উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিহত গতিতে ধাবমান বর্তমান বাংলাদেশের কতজন মানুষ এই গতি থামিয়ে মেরামতের কাজ শুরু করতে আগ্রহী? গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত ২৭ দফা সংবলিত ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত রূপরেখা’র সংবাদ পড়ে আমার মনে এই প্রশ্ন দুটিরই প্রথম উদয় হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে ‘জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং বেগম খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে এই রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। রূপরেখায় বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোকে ভাঙিয়া চুরমার’ করা হয়েছে। অতএব এই রাষ্ট্রকে মেরামতের জন্য ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’। এই রূপরেখা সম্পর্কে উপরে উত্থাপিত প্রশ্ন দুটির পাশাপাশি এটিও বলা সঙ্গত যে, মেরামতপন্থিরা পদ্মা সেতু পার হওয়ার আগে অথবা মেট্রোরেল দিয়ে চলাচলের আগে অথবা বিদ্যুৎ সরবরাহের অব্যাহত ধারা ভোগ করার সময় অথবা কর্ণফুলী টানেল দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় অথবা সরকার কর্তৃক আমদানিকৃত কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন বিনামূল্যে নেয়ার সময় নিশ্চয়ই তাদের স্ব স্ব বিবেকের কাছে অনুগ্রহপূর্বক প্রশ্ন করে দেখেন! বর্তমান উন্নয়নের ধারা বন্ধ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিরাজিত ভয়াবহ মেরামতের (!) কাজ পুনরায় শুরু করা প্রয়োজন কেন? এটা বলা হচ্ছে এ কারণে যে, ‘মেরামতপন্থিরা’ তো এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর হয়ে আছেন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান এগিয়ে চলা থামিয়ে মেরামতের পরে আবার চলা শুরু করতে হবে! কিন্তু সব কিছু থামিয়ে মেরামতের কাজে নেমে পড়া কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এতদসত্ত্বেও প্রশ্ন একটা থেকে যায়। আর তা হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মেরামতের জন্য কোনো কোনো বিষয় স্মরণ ও বিবেচনা করা প্রয়োজন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরের যৌক্তিক ভিত্তি হতে পারে সমসাময়িককালের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী চিন্তক এবং ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড হ্যালেট কারের (১৮৯২-১৯৮২) ধারণা। তার ‘হোয়াট ইজ হিস্টরি’ গ্রন্থে ইতিহাসকে ‘বর্তমান ও অতীতের মধ্যে একটি সংলাপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে ইতিহাস হলো অতীত এবং বর্তমান এবং আজ এবং গতকালের সমাজের মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়া। কীভাবে অতীতের ঘটনাগুলো আজকের মতো হয়েছে ইতিহাস অধ্যয়ন তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমরা কেবল নিজের সম্পর্কে এবং কীভাবে আমরা বর্তমানে উপনীত হয়েছি তা শিখি না, এই সঙ্গে ভুলগুলো এড়াতে এবং আমাদের সমাজের জন্য আরো ভালো পথ তৈরি করার ক্ষমতাও বিকাশ করি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করে বলা যায়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মেরামতের জন্য বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিচার করা। গণহত্যার জন্য দোষীদের বিচারের আওতায় দিয়ে আসা। স্বাধীন হওয়ার আগে তৎকালীন পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের যে সম্পদ পাওনা ছিল তা ফিরে পাওয়া ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির একটি প্রধান কাজ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষণার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া এখন সময়ের দাবি। লন্ডনে অবস্থানরত বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম অপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দিনকে ফিরিয়ে এনে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা। রাষ্ট্র মেরামত বলতে বর্তমান সময়ে এগুলো অপরিহার্য এবং অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বিএনপি তাদের মেরামতের রূপরেখায় এসব বিষয় সংযোজিত করতে লজ্জাবোধ করে কেন? পাশাপাশি, কার-এর সূত্র অনুসারে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা এবং বর্তমান বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সত্তাগুলোর তৎপরতার তাৎপর্য ও অর্থ খোঁজার জন্য আমাদের অতীতের দিকে মাথা ঠাণ্ডা করে নজর দেয়া অপরিহার্য। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তানের সৃষ্টি হয় সে সময় বাঙালি জাতির জন্য ভবিষ্যৎ স্বাধীন আবাসভূমির নিমিত্তে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ এবং বেকার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও সক্রিয়তা কেমন ছিল তা জানা প্রয়োজন। এরপর বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শত্রæতামূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে তাদেরকে (বাঙালিদের) ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বাঙালিরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তার ফলশ্রæতিতে লৌহ সামরিক শাসক ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এরই ফলশ্রæতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল সেনা শাসক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে শতকরা ৭৪.৯ ভাগ ভোট লাভ করেছিল। অন্য যেসব দল অংশগ্রহণ করেছিল সেগুলোর প্রাপ্ত ভোটের শতকরা মোট হার ছিল ২০.৪ ভাগ। এগুলো হলো পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) শতকরা ১.০ ভাগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) শতকরা ২.৮ ভাগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) শতকরা ১.৬ ভাগ, জমিয়ত-ই-উলামা ইসলাম শতকরা ০.৯ ভাগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি শতকরা ১.৮ ভাগ, জামায়াতে ইসলামী শতকরা ৬.০ ভাগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক লীগ শতকরা ২.৯ ভাগ, স্বতন্ত্র শতকরা ৩.৪ ভাগ। এর মধ্যে শুধু ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফ্ফর) প্রাপ্ত ১.৮ ভাগ বাদ দিলে থাকে শতকরা ১৮.৬ ভাগ। এই ১৮.৬ ভাগ ভোটার ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগবিরোধী। এর সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা মওলানা ভাসানীর অনুসারী ভোটারদের সংখ্যা মিলে শতকরা ২০+ভাগ ভোটার এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে সৃষ্ট জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করার পর স্বাভাবিক হিসাবেই ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত শতকরা ৭৪.৯ ভাগ ভোট থেকে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৪-৭ ভাগ ভোট এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ১৮.৬ ভাগ ভোটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শতকরা ২২.৬-২৫.৬ ভাগে দাঁড়ায়। কিন্তু ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাক্সের ভোট সামান্য কিছু কম হলেও তাতে নিরঙ্কুশ বিজয়ে কোনো বাধা হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার পর এই হিসাবে আরও হ্রাসবৃদ্ধি হয়েছে। খুনি খন্দকার মোশতাক কর্তৃক গঠিত ডেমোক্রেটিক লীগে আওয়ামী লীগ থেকে বেইমানি করে বের হয়ে যাওয়া কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। জেনারেল জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করার পর এসব আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিক জিয়ার দলে যোগদান করে। জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভের কারণে সামরিক শাসকের প্রতি শুধু কৃত্রিমভাবে সমর্থনসূচক ভুয়া ভোট প্রদানের পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে, বিশেষত দ্বিতীয় সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করার পর পুনরায় আওয়ামী লীগ থেকে কিছু, বিএনপি থেকে কিছু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ফলে এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে পূর্বসূরি জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যে দল গঠন করেন সেই দল একদিকে আওয়ামী লীগের ভোটের মধ্যে এবং অন্যদিকে বিএনপির ভোটারদের মধ্যে অংশীদারিত্ব কিছুটা হলেও কায়েম করে। এরপর ১৯৯০-এর দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সূচিত হয় এবং তারপরে বিএনপির অনেক কর্মকাণ্ড ইতিহাসের কাঠগড়ায় জ¦লন্ত প্রশ্ন হয়ে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে রাষ্ট্রের সংবিধানে সংযোজিত করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সরাসরি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের আওতা থেকে রেহাই দেয়া এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এসব জঘন্য খুনিদের পুনর্বাসিত করা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য দেশকে বসবাসের অনুপযোগী করে তোলা প্রভৃতি। এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা ওরফে নির্বাচনে জয়লাভের রূপরেখা ঘোষণা করেছে। কিন্তু সুষ্ঠু ভোটের হিসাবেও বিএনপির কপালে ‘ক্ষমতা’র ভাগ্য জুটবে কিনা তা এখনই বলা না গেলেও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ইতিহাসভিত্তিক ভোটের পরিসংখ্যান খতিয়ে এটি অন্তত নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বিএনপির মেরামতপন্থি ভোট বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও উন্নয়নমুখী ভোটের চেয়ে অনেক কম! বিএনপির কাছে অপছন্দ হলেও এটি সত্যি যে, চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এখন একটি জনপ্রিয় আকাক্সক্ষা। ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App