×

সারাদেশ

শান্তিগঞ্জের হাওর পানিশূন্য, দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৪৮ পিএম

শান্তিগঞ্জের হাওর পানিশূন্য, দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

শান্তিগঞ্জের হাওর পানিশূন্য হয়ে পড়ায় কৃষকদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাজ। ছবি: ভোরের কাগজ

শান্তিগঞ্জের হাওর পানিশূন্য, দুশ্চিন্তায় কৃষকরা
শান্তিগঞ্জের হাওর পানিশূন্য, দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

মাছ এবং ধানের ভাণ্ডার খ্যাত সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে হাজার হাজার একর জমি। এসব এক ফসলি জমি থেকে প্রতি বছরই কৃষকদের ঘরে তোলা হয় লাখ লাখ মেট্রিক টন ধান। যা সরকারি খাতে যুক্ত হয়ে সরাসরি অবদান রাখে জাতীয় অর্থনীতিতে। এজন্য সুনামগঞ্জ জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাওর হিসেবে আলাদাভাবে মুল্যায়ন করা হয় এই হাওরকে। তবে এই বছর গুরুত্বপূর্ণ হাওরটি কতটুকু তার নিজেস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মনে।

হাওরের দুই-একটি বিল-ঝিল-ডোবার কথা বাদ দিলে সম্পূর্ণ হাওর এখন পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এতে পৌষের শুরুতেই সব জমিই ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জমিতে চাষাবাদ করতে পারবেন না কৃষকরা। পতিত থেকে যাবে হাওরের বিপুল সংখ্যক জমি। এ তো শুধু দেখার হাওরের চিত্র। শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের জামখলা হাওর, পূর্ব পাগলার কাঁচিভাঙ্গা, আইডরা, বড়কূল, দেখার হাওরের পূর্বাংশ, পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের নাগডরা, তেছারকোনার পশ্চিমাংশ, ডুকলাখাই, পূর্ব বীরগাঁও ও পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের রাঙামাটি, শল্যার দাইর, খাইহাওরসহ উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি ছোট বড় হাওরের এমন কিংবা এর চেয়েও করুণ দৃশ্যের চোখে পড়ে।

সরেজমিন শনিবার উপজেলার পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের দিকে গিয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দেখার হাওরের পূর্বাংশে উত্তর বাউশী চক মৌজায় নোয়াগাঁও, চুরখাই ও বেতকোনা গ্রামের আশপাশে প্রায় ১০০ একর জমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। জমিতে ফাটল ধরেছে দুই থেকে চার ইঞ্চি। যেনো প্রতিটি জমি পানির জন্য হা করে বসে আছে। পুটিয়া নদীর পানি দিয়ে এ মৌজার বেশির ভাগ জমি চাষাবাদ করা হয়। পুটিয়া নদীতে পানি নেই। এ নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় সরু এ নদীর পানি পৌষ মাসের আগেই নেমে গেছে বা শুকিয়ে গেছে। একই অবস্থা ইউনিয়নের আইডরা, বড়কূল (মহাসিং নদীর পূর্বপাড়) হাওরের। পানি শূন্যতায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে আছে এসব হাওরের জমিও।

পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের চিকারকান্দি গ্রাম থেকে সোজা উত্তর দিকের রাস্তার ধরে রাস্তার শেষ মাথায় এগুলো কচুয়া গাঙ বা কচুয়া বিল। এই বিল থেকে ধরে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে যতদূর চোখ যায় পুরোটা অংশই দেখার হাওর। কচুয়া বিলের মাঝখান দিয়ে দূর থেকে কয়েকজন মানুষ হেঁটে আসতে দেখে এ প্রতিবেদকও এগিয়ে যান তাদের দিকে। কথা বলেন কৃষকদের সঙ্গে। তারা জানান, কচুয়া গাঙের আশপাশে কিছু পানি দেখা যায় ঠিক কিন্তু এ পানি দিয়ে যেসব জমি আছে তা ভিজানোই যাবে না। প্রতিটা জমিতেই পানির দরকার। জমি ফেটে গেছে। হালচাষও করা যাবে না। যদি পাওয়ার পাম্প দিয়ে পানি তুলা হয় তাহলে জমিতে খরচ পড়বে দ্বিগুণ বেশি। খরচে আর ধানে কৃষকদের পোশাবে না, তাই কেউই জমিতে নামছেন না। এতে জমি পতিত থাকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এদিকে, পশ্চিম পাগলার নাগডরা, ডুকলাখাই, তেছারকোনার পশ্চিমাংশ, আসামপুর-আস্তমা গ্রামের দেখার হাওরের অংশ, দরগাপাশা, পশ্চিম বীরগাঁও ও পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের সব হাওরের দৃশ্য একই। কৃষকরা পাশের নদী, খাল বা জলাশয় থেকে পানি আনতে চেষ্টা করলেও অতিরিক্ত খরচ হওয়ার ভয়ে কেউই যাচ্ছেন না। বর্গাচাষীরা জমির মালিককে জমি ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন।

হাওরের এসব সমস্যা নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন হাওরের একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, কিছু অসাধু মৎস্য শিকারি মাছ ধরার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাঁধ ভেঙে পানি ছেড়ে দিয়ে মাছ ধরা, নদী কিংবা জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, বিভিন্ন নদী, বিল-ঝিল ও জলাশয়ের নাব্যতা কমে যাওয়া ও কিছু প্রয়োজনীয়র জায়গায় বাঁধ নির্মাণ না করা পানি শূণ্যতার অন্যতম কারণ। নদীতে পানি ধরে রাখতে হলে নদীর নাব্যতা বাড়ানো ও যেসব নদী বা জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে জমি চাষ করা হয় সেসব নদী-জলাশয়ের নিলাম পদ্ধতি বাতিল করার উপর জোর দেন কৃষকরা। তারা বলেন, যদি নিলাম দিতেই হয় তাহলে নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে দিতে হবে। যেনো সেসময়ের মধ্যে পানি সেঁচে মাছ আরোহন না করে। এবং নদীর নাব্যতা বাড়াতে হবে। তবু্ও কৃষকরা কষ্ট করে হলেও জমি চাষে কিছুটা আগ্রহী হতেন যদি জ্বালানি তেল বিদ্যুতের দাম কম হতো। আগে যে জমি চাষে খরচ হতো ৪ হাজার টাকা বর্তমানে লাগবে দ্বিগুণ।

পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের খুদিরাই গ্রামের তুরন খাঁন নামের এক কৃষক বলেন, দেখার হাওরে আমার প্রায় ৩০ কিয়ার (প্রায় ১০ একর) জমি আছে। হাওরে পানি নাই, নদী থেকে যে পানি তুলবো তাও সাহস পাচ্ছি না। জ্বালানি তেলের দাম খুব বেশি, বিদ্যুতের দামও বেশি, শ্রম-শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় হালচাষ, ধানের চারা সব কিছুর দাম বৃদ্ধি। যে জমিতে আগে খরচ পড়তো সাড়ে চার হাজার টাকা এখন প্রায় ৭ হাজার টাকা খরচ হবে একই জমিতে। সে তুলনায় ধানও হবে না। তাই ১০ কিয়ার বর্গা দিয়েছি। বাকী জমি চাষ করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুরন খাঁনের এ বক্তব্যের সাথে গলা মিলান পূর্ব পাগলার আইডরা হাওরের কৃষক আছকির উদ্দিন, বড়কূলের কৃষক সুমন মিয়া ও পাগলার ইনাতনগর গ্রামের ডুকলাখাইর কৃষক আলী আমজাদ।

নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক আবদুস সাত্তার, চুরখাইর আতাউর রহমান, বেতকোনার নূর আলী, সিচনী গ্রামের কলমদর আলী, ইসলামপুরের মাহমদ আলী, নাগডরার কৃষক খোয়াজ আলী, জামখলার হাওরের কৃষক নূর মোহাম্মদসহ আরো বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই কৃষককে বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে সরকার পক্ষকে। যেখান বাঁধ দেওয়া দরকার সেখানে বাঁধ দিতে হবে। কৃষকের স্বার্থে সেঁচ দিয়ে মাছ না ধরার উপর জোরারোপ করতে হবে। জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হবে। যেখানে পানি আটকানোর ব্যবস্থা নাই সেখানে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

জমির মালিক ইরান উদ্দিন বলেন, অনেকে আমার জমি চাষ করেন। জমিতে পানি না থাকার কারণে ও খরচ বেশি হবে এই ভয়ে এ বছর যারাও জমি চাষের জন্য নিয়েছিলেন তারা জমি ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এসব জমি এই বছর পতিত থাকবে।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বলেন, কোনো কোনো হাওরের এমন অবস্থা এসব হাওরের কৃষকরা যদি লিখিতভাবে অবিহিত করেন তাহলে তাহলে আমরা দেখবো হাওরে পানির ব্যবস্থা করা যায় কিনা। কোন কোন নদীর নাব্যতা কমেছে তাও জানাতে হবে। এরপর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App