×

মুক্তচিন্তা

ইরানে ধর্মীয় চোখ রাঙানি বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:২৮ এএম

ঘটনার সূত্রপাত ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরানে সপরিবারে একটি গাড়িতে ফিরছিলেন ২২ বছরের ইরানি তরুণী মাহসা আমিনি। সেই সময়ে তাদের গাড়ি আটকায় ইরানের নীতি পুলিশ। গাড়িতে মাহসা হিজাব পরেননি বলে পরিবারের সামনেই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। পরে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় ওই তরুণীর। তার পর থেকে ইরানে দিকে দিকে অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় নেমে হিজাব পোড়ানো থেকে শুরু করে মাথার চুল কেটে ফেলা বিভিন্ন অভিনব পন্থায় প্রতিবাদে নামে সে দেশের নারী-পুরুষ। সরকারের বেঁধে দেয়া পোশাকবিধির বিরুদ্ধে ও মেয়েদের ওপর প্রশাসনের নীতি পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। ইরানের হিজাববিরোধী তীব্র আন্দোলন সমর্থন জানান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মহিলা-পুরুষ, এমনকি খ্যাতনামারাও। এমনকি ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচের আগে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইরানের ফুটবলাররা। বেজে চলেছে জাতীয় সংগীত অথচ নির্বাক তারা। ক্যামেরায় দেখা গেছে, স্টেডিয়ামে হাজির বহু সমর্থকও চুপ। বার্তা স্পষ্ট, হিজাববিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন রয়েছে তাদের। জানা গেছে, ম্যাচের আগে ইরানের ফুটবলাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিলেন এই নিয়ে। তাতে বেশির ভাগই জাতীয় সংগীত না গাওয়ার পক্ষে ভোট দেন। যদিও চাপে দ্বিতীয় ম্যাচেই জাতীয় সংগীত গাইতে হয় তাদের। ইতোমধ্যে বিচার চলছে ইরানের জাতীয় যুবদলের প্রাক্তন ফুটবলার ২৬ বছরের আমির নাসির-আজদানির। অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যাকে তারা বলছেন ‘মোহারাবেহ’। এই ফার্সি শব্দটির অর্থ ‘ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা’। জানা গেছে, ফাঁসি হতে পারে তার। আমিরের ফাঁসির খবরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরানের আন্তর্জাতিক ফুটবল সংগঠন। প্রতিবাদে শামিল হন কলম্বিয়ান পপ গায়িকা শাকিরাও। আগে দেখে নেয়া যাক এই নীতি পুলিশ কারা? ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নীতি পুলিশ বাহিনী, যাদের পোশাকি নাম ‘গস্ত-এ-এরশাদ’। এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘পথপ্রদর্শক বাহিনী’। প্রকাশ্যেই জানানো হয়েছিল, এই বাহিনীর লক্ষ্য হবে ইরানে হিজাব সংস্কৃতি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করা। মেয়েদের ‘শালীনতা’র পাঠ দেয়া। ইরানের বক্তব্য- বিচারব্যবস্থার অন্তর্গত না হলেও যেহেতু দেশের সরকারের প্রধানের হাতেই এর সৃষ্টি এর প্রয়োগ হবেই। সেই নীতি পুলিশেরই শিকার হন ইরানের তরুণী আমিনি। ইরানের ‘পোশাকবিধি’ না মানায় উচিত শিক্ষা দিতেই গস্ত-এ-এরশাদের বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে লকআপে বন্দি করেছিল। ধরে নেয়া হয়, পোশাকবিধি না মানার শাস্তি দিতে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছিল আমিনির ওপর, যার জেরেই মৃত্যু হয় তার। অন্য বন্দিরাও জানিয়েছিলেন, আমিনির ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল। এরপর থেকে টানা আন্দোলন। কিন্তু এবারে প্রশ্ন উঠছে নারী স্বাধীনতা বনাম ধর্ম সম্পর্কে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। ইসলাম ধর্মে পর্দা প্রথার বিধান আছে। ‘পর্দা’ শব্দটি মূলত ফার্সি। যার আরবি প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। অনেকে বলছেন, নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মাঝে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত এই আড়াল বা আবরণ। হিজাব বা পর্দা অর্থ শুধু পোশাকের আবরণই নয়, বরং সামগ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে অপবিত্র ও অবৈধ সম্পর্ক স্থাপিত না হয় এবং নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচারী আচরণ রোধ করা যায়। অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী আবার ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে, হিজাব ইসলামের অঙ্গ নয়। কুরআনে বলা আছে, পুরুষ বিশ্বাসীরা মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলত একটি পর্দার আড়াল থেকে। এই পর্দা বা স্কার্ফ পুরুষদের দায়িত্বের অংশ ছিল, মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রীদের নয়। কাজেই মুহাম্মদের স্ত্রীদের হিজাব প্রয়োগের নির্দেশ থাকলেও সাধারণ নারীদের নেই। কুরআনেও হিজাবের উল্লেখ রয়েছে মাত্র সাত বার। এর সঙ্গে নারীদের পোশাক রীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি নিয়ে তর্ক চলতে পারে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে, কিন্তু হিজাব নিয়ে মৃত্যু, ফতোয়া দেয়া ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না। বিশ্বে ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ব হিজাব দিবস পালন হচ্ছে ধর্মীয় কারণে নয়, বরং স্টাইল স্টেটমেন্টের অনুসারী হিসেবে। এ কথা সত্যি, ভারত ও বাংলাদেশে গত দুই দশকে নারীদের মধ্যে হিজাব ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একদল বলছে- হিজাব ব্যক্তি-পছন্দ, আরেক দল বলছে এটা সম্পূর্ণ চাপিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে কয়েকটা প্রশ্ন উঠে আসছে। হিজাব কি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হতে পারে? ভারতে হিন্দুত্ববাদ বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে হিজাবের ব্যবহার বেড়েছে? বাংলাদেশে হিজাবের ব্যবহার বৃদ্ধি কি রাজনৈতিক কারণে? হিজাব কি মেয়েরা নিজেদের সিদ্ধান্তে পরছে, নাকি সমাজ এবং পরিবার তাদের বাধ্য করছে? হিজাবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কি অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে ভিন্ন হচ্ছে? হিজাব কি আসলেই নারীকে স্বাধীনতা দেয়, নাকি এটা নারীকে আরো বেশি পরাধীন করে? এই একটা পোশাক নিয়ে এত আলোচনার আবশ্যকতা আছে কিনা? একটা কথা সত্যি, যে কোনো পোশাকই ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন পছন্দ থেকে আসে না। পোশাক নির্বাচনে ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো এবং ভৌগোলিক অবস্থান মানে আবহাওয়া, মুখ্য ভূমিকা পালন করে বা শর্ত হিসেবে কাজ করে। কোন দেশ বা অঞ্চলের পোশাক কেমন হবে, সেটার একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিক প্রেক্ষাপটও থাকে। আর যারা লিঙ্গীয়-রাজনীতিতে সমাজকে বিশ্লেষণ করেন, তারা মনে করেন- নারীর পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুরুষ বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সিদ্ধান্ত নেয় বা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ পোশাকনির্ভর করে ক্রেতার অর্থনৈতিক অবস্থান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো, আবহাওয়াজনিত কারণ এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ওপরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়, জিও পলিটিকস। যেমন গান্ধীর চরকায় বোনা মোটা কাপড় তার স্বদেশি আন্দোলনে আলোচিত হয়ে আছে। দেশীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে বা জাতীয়তা বোধকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে পোশাক একটি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। মানে জিও পলিটিকসকে পোশাকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে মুজিব কোট, জিন্নাহ টুপি এই পোশাকগুলো রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। ৯/১১ পর ভৌগোলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলিমদের প্রতি বিরূপতার প্রতিবাদ হিসেবে আমেরিকায় মুসলিম ফেমিনিস্ট মেয়েরা হিজাবকে তাদের আইডেনটিটি মুভমেন্টের অংশ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। ভারতে ১৯ শতাংশ ও পশ্চিমবঙ্গে ৩০ শতাংশ। চর্চার মাত্রায় পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু এরা বেশির ভাগই ধর্মচর্চাকারী মুসলমান। বিংশ শতকের গোড়ার দিকেও ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান নারীরা এই হারে হিজাব বা বোরকা পরত না। কিন্তু আজ পরছে। কারণ সংস্কৃতি কোন কনস্ট্যান্ট বা অপরিবর্তিত বিষয় না। সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এর মধ্যে অভিযোজন, বিয়োজন ঘটছে। একটা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অনেক অংশের একটা অংশ হলো পোশাক। এই পোশাক বা ফ্যাশনটাই হচ্ছে সবচেয়ে পরিবর্তনশীল এবং সহজে পরিবর্তনশীল। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ধরে নেয়া হয় এক দশক। মোটামুটি এক ধরনের ফ্যাশন ১০ বছর টেকে। কাজেই প্রায় দুই দশক হিজাবের ফ্যাশন প্রচলিত থাকার পরে এখন ভাটার টান। এখন কথা উঠছে পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতার, হিজাব বর্জনের। ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকতা প্রবেশ করেছে মানুষের বেড রুমে। সালোয়ার-কামিজ তো ভারতীয় ও পাকিস্তানি সংস্কৃতি, বাঙালির নয়। কিন্তু আজ তা সব সমাজে সমাদৃত। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, পোশাক হিসেবে হিজাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কারণে বেশির ভাগ মহিলা হিজাব পরেন, ধর্মীয় বিধানের জন্য নয়। পোশাকটির উদ্ভব, উৎপত্তি এবং বিস্তার এর তত্ত্বগত যে উৎস সেটাকে মাথায় রেখে তারা হিজাব পরেন না। প্যালেস্টাইনে আমরা দেখেছি, হিজাব পরিহিতা নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। কিন্তু পোশাকের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব পছন্দ নেই। সেটা স্থির করে পুরুষ। কাজেই আজ যে হিজাববিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার মূল কারণ নারী পছন্দের ওপরে পুরুষের মাতবরি। জানুয়ারি, ১৯২২ এ কলেজে পোশাকবিধি স্থির করতে কর্নাটক সরকার একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী নির্দেশিকা প্রকাশ করে জানানো হয়, হিজাব বা গেরুয়া উত্তরীয় কিছুই পরার অনুমতি নেই। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উদুপির কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী কর্নাটক হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেন। তারা আদালতকে জানান, হিজাব পরা তাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। কোনোভাবেই তা বাতিল করা যায় না। কিন্তু মার্চ মাসে কর্নাটক হাইকোর্ট পরিষ্কার বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেয়া পোশাক পরেই পড়–য়াদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে হবে। তবে যেসব কলেজে কোনো পোশাকবিধি নেই, সেখানে এমন পোশাক পরা যাবে না, যাতে শিক্ষাঙ্গনের ভারসাম্য, ঐক্য এবং শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। সেই বিধি ব্যবস্থা বলবৎ আছে ভারতে। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সংবিধানেও ধর্মীয় আচার পালন ব্যক্তিগত বলেই স্বীকৃত। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম যে দেশে আছে, তারা এবার ইরানের ঘটনায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেবেন, সেটাই দেখার। মাহসা আমিনির মৃত্যু বা আমির নাসির-আজদানির মৃত্যুদণ্ড কতটা ধর্মস্বীকৃত, সেটাও বলার পালা এবার মুসলিম বিশ্বের। ইরান যতই নীতি পুলিশ তুলে নিক, এখনো যে সে দেশে শরিয়াহ বিধান মুখ্য, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে প্রতি পদে। কাজেই ধর্মীয় চোখ রাঙানি বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতার যুদ্ধ আবার শুরু হয়েছে এবং তা মুসলিম বিশ্বে। এবারে কে জেতে সেটাই দেখার। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App