×

সারাদেশ

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাতক-সিলেট রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৪৮ এএম

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাতক-সিলেট রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ

ছবি: ভোরের কাগজ

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাতক-সিলেট রেলপথকে আধুনিকায়ন করতে ২শ ২২ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জানা যায়, ছাতক-সিলেট রেলপথ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় সংস্কার করে শীঘ্রই রেল যোগাযোগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছাতক সিলেট রেলপথ সংস্কারের জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ধরনের সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে রেলওয়ে বিভাগ।

এরআগে গত ১৩ নভেম্বর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাতক-সিলেট রেলপথ পরিদর্শন করেছেন রেলওয়ে বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং এশিয়া উন্নয়ণ ব্যাংকের (এডিবি) একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় তারা রেললাইন পুনঃসচল করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ছাতক-সিলেট রেলপথ ও স্টেশনগুলো আধুনিকায়ন করার গৃহীত পরিকল্পনার কথাও জানান প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন সব ঠিকঠাক থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যে ছাতক-সিলেট রেলপথ ও স্টেশনগুলো আধুনিকায়ন করে পুনরায় রেল যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।

ওই দিন রেলওয়ে সিলেটের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসাইন, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কনসালডেন্ট রাকিবুল ইসলামসহ প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তারা বিকেলে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশনে জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এ সময় ছাতক-সিলেট রেলপথ পুনরায় চালু করার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তারা। পরে আরও দুই দফায় রেলপথ পরিদর্শন করেছেন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী ও এডিবির কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সিলেটের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসাইন, সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (ছাতক বাজার) জুবায়ের আহমদ, সিলেটের ঊর্ধ্বতন সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) জুয়েল হোসেন, ঊর্ধ্বতন সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জুলহাস, উপ- সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল নূরসহ কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির সময় থেকে রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এবং বন্যায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাতক থেকে আফজলাবাদ পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রেলপথ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফজলাবাদ থেকে খাজাঞ্চিগাঁও পর্যন্ত আরও ১২ কিলোমিটার রেলপথ। ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ মেরামতের জন্য ইতোমধ্যেই ২২ কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ হয়েছে। পরবর্তীতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছাতক-সিলেট রেলপথকে আধুনিকায়ন করতে ২শ ২২কোটি টাকার নূতন একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে রেলপথের কয়েকটি ব্রিজের সংস্কার কাজও ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।

রেলপথ সংস্কার কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুপার ভাইজার আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, রেলপথের ব্রিজগুলোর কাজ করছেন তারা। রেল লাইন মেরামতের কাজ এখনো শুরু হয়নি। লাইন মেরামতের জন্য জরিপ চলছে। তিনি বলেন, ছাতক থেকে সিলেট পর্যন্ত রেল লাইনে ছোট-বড় ব্রিজ রয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে ছাতক অংশে ১০ টি ব্রিজ। ইতোমধ্যে রেলপথের ৩১ টি ব্রিজের মেরামত কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাতক-সিলেট রেলপথে সংস্কার কাজ শুরু করায় জনমনে আশার আলো দেখা দিয়েছে। বিগত বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ছাতক থেকে সিলেট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেলপথের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। ছাতক থেকে আফজলাবাদ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেলপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেলপথের এই অংশ প্রায় লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেছে। অধিকাংশ স্থানে রেলপথের মাটি-পাথর সরে ঝুলে ঝুলে রয়েছে স্লিপার।

করোনা মহামারির সময়ে এই রেলপথে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ চালু অবস্থায় ছাতক-সিলেট রেলপথে রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বন্যার আগপর্যন্ত এই রেলপথে আর রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। এর মধ্যে বন্যায় রেলপথের অধিকাংশ স্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এই রেলপথে যাতায়াতকারি ৩ উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

১৯৫৪ সালে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ে এই রেলপথের সর্বশেষ স্টেশন হিসেবে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। আগে এটি ছিল আখাউড়া-কুলাউড়া-সিলেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর, বালি, চুনাপাথর, কমলালেবু ধান-চাল ও তেজপাতাসহ বিভিন্ন মালামাল আনা-নেওয়ার জন্যই মূলত রেলপথটি নির্মিত হয়েছিল। পরে এখানের কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল পরিবহন, ছাতক দোয়ারাবাজার অঞ্চলসহ সুনামগঞ্জ জেলার মানুষের যাতায়াত সুবিধার ব্যাপক উন্নতি হয় এই রেলপথের মাধ্যমে। এই অঞ্চলের মানুষের সে সময় থেকেই ছিল একমাত্র ভরসা রেলপথ। শুরু থেকেই রেল বিভাগের রাজস্ব আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ছাতক-সিলেট রেলপথটি।

১৯৭৯ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রাজস্ব আয়ে ছাতক বাজার স্টেশন শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখলে করে নেয়। ছাতক থেকে সিলেট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেলপথে যাত্রী ভাড়া মাত্র ১২ টাকা। এদিকে ট্রেনের ভাড়া ১২ টাকার বিপরীতে বাস ভাড়া বর্তমানে ৮০ টাকা ও সিএনজি ভাড়া ১শ ৩০ থেকে দেড়শ টাকা।

সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও সহায়তার চাল-গম ইত্যাদি এই রেলপথে পরিবহনেও অনেক সুবিধা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলপথে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ছাতক নিয়ে এসে নৌপথে জেলার অন্যান্য উপজেলায় পৌঁছানো যেত সহজ। এতে ট্রাক ভাড়ার চেয়ে প্রায় কয়েকগুণ সরকারি অর্থ আগে সাশ্রয় হতো বলে জানা গেছে।

রেলপথটি লাভজনক হওয়ার কারণে পাথর পরিবহনের জন্য দেশের একমাত্র ছাতক-ভোলাগঞ্জ রজ্জুপথ স্থাপন করে রেলওয়ে বিভাগ। এখানে স্থাপিত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি কংক্রিট স্লীপার প্ল্যান্ট। সরকারের এই দুটি প্রকল্পও এখন বন্ধ রয়েছে। ছাতকে রয়েছে রেলওয়ের ৩৫০ একর মূল্যবান ভূমি ও শতাধিক স্থাপনা। ভোলাগঞ্জেও রয়েছে রেলওয়ে বিদ্যালয়, রেস্ট হাউজসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা এবং ২ শতাধিক একর ভূমি। সবই ঠিক-ঠাক শুধু মাত্র রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথটি দ্রুত সংস্কার না হলে রেলওয়ের স্লিপারসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি চুরি হয়ে যাবারও আশংকা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

রেল যোগাযোগ না থাকায় অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে থাকেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে রেলওয়ে স্টেশনসহ সরকারি কোটি-কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ এখানে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ছাতক-সিলেট রেলপথে প্রতিদিন তিনটি ট্রেন যাতায়াত করতো। তবে নানান অজুহাত দেখিয়ে কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেন ও ট্রেনের বগি সংখ্যা। ট্রেনে করে প্রায় ৪৫ মিনিটে ছাতক থেকে সিলেট পৌঁছানো সম্ভব। ছাতক সিলেট রেলপথে ট্রেন খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে। ছাতক অঞ্চল, দোয়ারাবাজার সিলেটের সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাও এলাকার হাজার হাজার মানুষের সিলেট শহর ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই ছিল রেলপথ।

রেল বিভাগের সিলেটের পূর্বাঞ্চলের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন আরও জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ রেললাইন মেরামতের জন্য নতুন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। রেল বিভাগের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কর্মকর্তারা তদারকি করছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App