×

অর্থনীতি

সাড়ে ৭ লাখ কোটির বাজেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০১ এএম

বিশ্বমন্দা মোকাবিলা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ভোটের বছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার হতে পারে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় বাজেট প্রণয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করছে অর্থবিভাগ। নিত্যপণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেয়া হচ্ছে বাজেট পরিকল্পনায়। এজন্য বাড়ানো হবে কৃষি উৎপাদন। জনজীবনে স্বস্তি দিতে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে আগামী বাজেটে। এছাড়া করহার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানো এবং ব্যবসাবান্ধব বাজেটে প্রণয়নে গুরুত্ব দেয়া হবে। তবে সবচেয়ে বড় হবে- চ্যালেঞ্জ ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনা।

জানা গেছে, চলতি বাজেট বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে ভর্তুকি ব্যয় বাড়ানো। দাম বাড়িয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কিছুটা সমন্বয় করা হলেও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সার ও খাদ্যপণ্য আমদানি খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে অপেক্ষাকৃত বেশি জনবান্ধব কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের বিষয়টিতে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ানো এবং দারিদ্র্য কমানোর মতো কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, মহামারি করোনার ক্ষয়ক্ষতি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে চাপের মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি। সেই চাপ সামলাতে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পথে হাঁটছে সরকার।

এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার চলতি অর্থবছরের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া সভায় কৃষিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও অর্থ, এনবিআর, বাণিজ্য, কৃষি ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট সচিবরা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন। বৈঠকের ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে অর্থবিভাগ। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকে চলতি বাজেটে আরো বেশি কৃচ্ছ্রতা সাধনের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় তিনি কর্মকর্তাদের জানান, করোনা মহামারি বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সেই সময় আগেভাগে প্রস্তুতি এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধ কতদিন চলবে কেউ জানে না। তবে যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হতে যাচ্ছে। আমেরিকা-ইউরোপে মন্দা শুরু হলে তার প্রভাব পড়ে সারাবিশ্বে। এ কারণে বাংলাদেশও মন্দার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। অর্থমন্ত্রী জানান, এবারও মন্দা মোকাবিলায় সক্ষম হবে বাংলাদেশ। বিশ্ব মন্দা মোকাবিলা করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। এ কারণে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আ হ ম মুস্তফা কামাল কর্মকর্তাদের বলেন, মন্দা মোকাবিলার বিষয়টি সামনে রেখে আগামী বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করতে হবে।

এছাড়া চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেন তিনি। বৈঠকে ডলার রেট নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে আগামী ছয়মাস আরো বেশি কৃচ্ছ্রতা সাধনের পথ অবলম্বন করতে হবে। ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনা এবং সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর মতো কর্মসূচি হাতে নেয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করতে চায় সরকার।

এ লক্ষ্যে বাজেটের আকার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাজেটের আকার সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণ করতে হলে বাজেটের আকার আরো বাড়ানো দরকার। কোনো কোনো কর্মকর্তা বাজেটের আকার ৮ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এ যাবতকালে কখনোই বাজেটের আকার ১০-১২ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়নি। অন্যদিকে কৃচ্ছ্রতা সাধনে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ও কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য ভোক্তাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ব মন্দা মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে অর্থ বিভাগ। এছাড়া চলতি বাজেটের বড় দুটি বিষয়ে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বৈশ্বিক সংকটের মুখে চাপা থাকা অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্য বাড়ছেই। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশের ওপর এবং মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি- প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে।

মন্দা মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব মন্দা মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। নতুন বছরের শুরু থেকেই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা জেঁকে বসতে পারে বলে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাংকও তাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। মূলত দুবছরের করোনা মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরেই বিশ্বে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা- যা মোকাবিলায় দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার হিমশিম খাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে মন্দার আভাস দেখা দিয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় কষ্ট বেড়েছে সাধারণ মানুষের। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিলাসদ্রব্য আমদানি সীমিত করাসহ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমিয়ে এনেছে। এরপর ডলার সংকট দূর হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় জানান, বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসবে। এর মধ্যে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, আমদানিকৃত খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে তার সঙ্গে দেশের বাজারের সমন্বয় সাধন করা এবং রেমিট্যান্স কমার মতো ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়লে বাংলাদেশের রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে কারণ তৈরি পোশাকের চাহিদা কমবে। তবে সঠিকভাবে এগুতে পারলে এখানে কিছুটা ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। কারণ বাংলাদেশ যেসব পোশাক রপ্তানি করে সেগুলো খুব উচ্চ মূল্যের নয়। জনশক্তি রপ্তানি কমে গেলে রেমিট্যান্স কমবে। এ কারণে দক্ষ-অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখন থেকে উদ্যোগী হলে মন্দা মোকাবিলা সহজ হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App