×

আন্তর্জাতিক

আত্মশুদ্ধি নাকি মার্কিন ব্লু প্রিন্ট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৫১ এএম

আত্মশুদ্ধি নাকি মার্কিন ব্লু প্রিন্ট

হেনরি কিসিঞ্জার

আন্তর্জাতিক রাজনীতির মানদণ্ডে ‘ভালো’ এবং ‘খারাপ’ এর মধ্যে কোনো স্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। বরং ট্র্যাজেডি হলো যুদ্ধবাজদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই মানবতার সংজ্ঞা বিবেচিত হয়। সম্প্রতি মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাঁদরেল কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার দি স্প্রাক্টেটর ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এর প্রেক্ষিতে পত্রিকাটির একজন বিশ্লেষক ক্যান্ডিস সেপ্লো গতকাল বলেছেন, শান্তির জন্য যদি কার্যকর ব্লু প্রিন্ট প্রণয়ন করতেই হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই ‘পশ্চিমা’ দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমের বাইরে ১৫০ কোটি চীনাদের মতামতও বিবেচনা করতে হবে। ১৫০ কোটি ভারতীয়, ২৪ কোটি পাকিস্তানি, ১৭ কোটি বাংলাদেশি, ২৮ কোটি ইন্দোনেশীয়, ২২ কোটি নাইজেরীয়, ২২ কোটি ব্রাজিলীয়, ১৪ কোটি মেক্সিকান প্রভৃতি দেশ ও জাতির ভাবনাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু আমরা খুব বেশি পরিমাণে মার্কিন এবং ইউরোপীয়দের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের বাইরে যেতে পারি না। আফ্রিকান, এশিয়ান বা ল্যাটিন আমেরিকানদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও ভাবতে হবে।

যুুদ্ধবিরতিই কি আপাতত সমাধান : বিশ্বব্যাপী বেশিসংখ্যক রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিক মনে করছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ সহসাই শেষ হবে না। এই যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হবে না, শুধু পরাজয় হবে একপক্ষের। তাই কিসিঞ্জার বলেন, আমাদের অবশ্যই মনোনিবেশ করতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্তের ক্ষতি কম হয়। যার অর্থ অবিলম্বে একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি। জাতিসংঘের সব সংস্থা বিশেষ করে সাধারণ পরিষদ, মানবাধিকার হাইকমিশন, শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন, উন্নয়ন কর্মসূচি, পরিবেশসংক্রান্ত সব সংস্থার দ্বারা এই নীতিতেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পুরনো দৃষ্টান্ত বাতিল করতে হবে। রাজনীতিবিদদের মূলধারার মিডিয়ার সাজানো ‘দেশপ্রেমিক’-এর পোশাক ছাড়তে হবে। পারমাণবিক উত্তেজনা কমাতে এবং সংলাপের একটা সেতু অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে।

কিসিঞ্জারীয় শান্তির নীলনকশা: সর্বশেষ কিসিঞ্জার ইউক্রেনের শান্তির জন্য একটি নীলনকশা দেন। তাতে রয়েছে-

১. জাতিসংঘ সনদের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধবিরতি, ২. বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ৩. বিদ্যুতের অভাব, খাদ্যের অভাব ইত্যাদির কারণে ভুগছেন এমন জনগোষ্ঠীর জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সহায়তার আয়োজন, ৪. জাতিসংঘের মাধ্যমে ক্রিমিয়া এবং দনবাসের গণভোট পর্যবেক্ষণ, ৫. নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া, যা বিশ্বের পরিষেবা নষ্ট করেছে, সরবরাহের চেইন ভেঙে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করেছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন করেছে, ৬. ইউরোপ এবং বিশ্বের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তার খসড়া তৈরি করা, ৭. সব পক্ষের অভিযোগ শোনার জন্য একটি সত্য কমিশন গঠন করা, ৮. সংশ্লিষ্ট সরকার কর্তৃক যুদ্ধাপরাধের শাস্তি, যেমন ইউক্রেনীয় অপরাধ ইউক্রেনীয় বিচারকদের দ্বারা তদন্ত ও বিচার করা এবং রাশিয়ার অপরাধের তদন্ত রুশ ট্রাইব্যুনাল দ্বারা শাস্তি দেয়া।

একটি যুদ্ধবিরতির সময়: হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, যুদ্ধবিরতির জন্য এখনই সবাইকে সম্মত হতে হবে এবং পোপ ফ্রান্সিসের মতো মধ্যস্থতাকারীদের টেনে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার মাধ্যমে শত্রুতার অবসানের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯১৬ সালে মার্কিন সরকারের কূটনীতির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের সুযোগ ছিল, কিন্তু সর্বজনশ্রদ্ধেয় উড্রো উইলসন ঘরোয়া রাজনীতির কারণে সেই সুযোগটি নষ্ট করেছিলেন।

প্রক্সি নাকি আসল যুদ্ধ: জীবন সায়াহ্নে এসে এই কূটনীতিক স্পষ্টভাবেই বর্তমান মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও মার্কিন কূটনীতিকে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী বললেন। কিসিঞ্জার বলেন, ইউক্রেনকে নিয়ে স্পষ্টতই একটি প্রক্সি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে ন্যাটো। ন্যাটো দেশগুলো রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য একটি গেইম খেলে যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে রাশিয়ানরা খুব দেশপ্রেমিক এবং তারা যখন হুমকি বোধ করবে তখন তারা লড়াই করবে, সে যেই হোক না কেন। কোনো নিষেধাজ্ঞাই রাশিয়ার জনগণকে পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে এবং তার জায়গায় মার্কিনবান্ধব কাউকে বসাতে প্ররোচিত করবে না।

ইতিহাসের শিক্ষা: কিসিঞ্জার বলেন, আমরা এরই মধ্যে কিউবার বিরুদ্ধে ৬২ বছরের কঠোর নিষেধাজ্ঞার অভিজ্ঞতা পেয়েছি, যা কমিউনিস্ট সরকারকে মার্কিনিরা নতজানু করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিকারাগুয়ার বিরুদ্ধে ৪০ বছরের নিষেধাজ্ঞা, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ২৩ বছরের অর্থনৈতিক যুদ্ধ শ্যাভেজ এবং মাদুরো সরকারের পতন ঘটায়নি। আমি ভেনেজুয়েলায় আমার অফিসিয়াল ইউএন মিশনের সময় শিখেছি, ভেনেজুয়েলার সিংহভাগ মানুষ তাদের সমস্যার জন্য মাদুরোকে দোষারোপ করে না- তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই দোষ দেয়।

তবুও তিনি মার্কিন: কিসিঞ্জার বলেন, অবশ্যই আমরা ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এর আগের পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারব না। খুব বেশি রক্তপাত হয়ে গেছে। তুরস্ক ২০২২ সালের মার্চ মাসে একটি শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘জয়’ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য জোর দিয়েছিল। এই অবস্থার জন্যে যুদ্ধের পরিণতি দীর্ঘ হচ্ছে। এরপরেও কিসিঞ্জার প্রস্তাব করেছেন, রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারির আগের জায়গায় ফেরত গেলেই শান্তি আসবে। এই কথায় কিসিঞ্জার তার দেশের পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে যুক্তি দেখালেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে দাবি করেন, ইউক্রেনের দ্বারা এই অঞ্চলগুলোয় আর শান্তি প্রতিষ্ঠা বা পুনর্মিলন করা অকল্পনীয় হবে। তখন যা হবে তা হলো গৃহযুদ্ধ, এমনকি গেরিলা যুদ্ধ। সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, যে কারণে কসোভানরা আর সার্বিয়ায় পুনর্মিলনে সম্মত হবে না, সে কারণেই ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের রুশ জনগোষ্ঠী আর ইউক্রেনের সঙ্গে যেতে চাইবে না।

পশ্চিমাদের অলীক ভাবনা: সমস্যা হলো- পশ্চিমের অনেকেই মনে করে, একটি যুদ্ধের মাধ্যমেই রাশিয়ার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া যাবে। পশ্চিমা মিডিয়াতে সর্বদা রুশবিরোধী প্রচারণায় যে বিষয়টি গুরুত্ব পায় তা হলো- ন্যাটো যা করছে তা ন্যায্য। মিডিয়া এরই মধ্যে মার্কিন এবং ইউরোপীয় জনসাধারণকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করাতে পেরেছে যাতে পরবর্তী রুশবিরোধী পদক্ষেপগুলো আরো ন্যায়সঙ্গত মনে হয়।

রুশরা বন্ধুবৎসল ও ইউরোপের রূপকার: জাতিসংঘের একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে কিসিঞ্জার বলেন, আমি রুশ ভাষা শেখার এবং তাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রুশ নাগরিককে বন্ধু বলে জানি। একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে, আমি রুশ মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করেছি। কিসিঞ্জার আধুনিক ইউরোপে রাশিয়ার ‘ঐতিহাসিক ভূমিকার’ কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি সতর্ক করেন যে, রাশিয়াকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করার চেষ্টা একটি বিশাল ভূখণ্ডকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ শূন্যতায়’ পরিণত করবে অথবা ওই এলাকাকে অন্তহীন যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রের রেসিপি হতে পারে ন্যাটোর পরিকল্পনা।

পশ্চিমের মূলধারার মিডিয়াগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগুনে ঘি ঢালতে থাকে। আজকের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন, কারণ রাশিয়ার আত্মসমর্পণের সম্ভাবনা শূন্য। পশ্চিমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, মহাসাগরগুলোয় রুশ সাবমেরিনগুলো সতর্ক রয়েছে যা পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত। আমাদের এমন একটি পারমাণবিক সংঘাতকে উস্কে দেয়া উচিত নয় যা এই গ্রহের মানব এবং প্রাণিজগৎকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দিতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App