×

জাতীয়

উত্তর-পূর্ব ভারতকে কতটা কাছে টেনেছে শিলচর-সিলেট উৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:১৮ পিএম

উত্তর-পূর্ব ভারতকে কতটা কাছে টেনেছে শিলচর-সিলেট উৎসব

ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রেফারেন্ডমের মাধ্যমে আসাম থেকে আলাদা হয়ে সিলেট বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। ওই ভোটের পর সিলেটের তিনটি থানা আসামের শিলচরের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাকি ৯টি থানা নিয়ে সিলেট নতুন যাত্রা শুরু করে। ৭৫ বছর পর এসে গত ২ ও ৩ ডিসেম্বর শিলচরের প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রথমবারের মতো হয়ে গেল শিলচর-সিলেট উৎসব। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও তিনজন সংসদ সদস্যসহ ১৪০ জনের বাংলাদেশি একটি প্রতিনিধিদল ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। অপরদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিং এবং ডোনার মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বিভিন্নজন বলেছেন, অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে আসামের পার্শ্ববর্তী রাজ্য মিজোরামের গভর্নর ড. হরি বাবু খাম্বাপামটি, মণিপুরের বাসিন্দা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিং, ভারতের ডোনার মন্ত্রী কিষাণ রেড্ডি এবং আসাম সরকারের মন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আসামের শিলচরে অনুষ্ঠান হলেও এতে আসামের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং গভর্নর জগদীশ মুখী ছিলেন না। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও তারা অনুষ্ঠানে দেখেননি। তবুও ওই অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলেছে। বিভিন্নজনের কথায় দুই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিমান, রেল ও বাস পরিষেবা চালু করা, নদী খনন, ভিসা সেন্টার চালুর মতো বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু এসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সে নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে, ডিসেম্বরের শুরুতে হয়ে যাওয়া শিলচর-সিলেট উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের, বিশেষ করে আসামের সম্পর্ক কতটা গাঢ় হলো?

অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে। নাড়ির সম্পর্ক হবে জোরদার। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, শিলচর-সিলেট উৎসবের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এ ধরনের কর্মসূচি আরো হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, এটাই আসল সংযোগ। এভাবেই জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ আরো গাঢ় হয়। এমন অনুষ্ঠান এখন ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তো আছেই। এমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এখন প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো উচিত। তাতে উভয়পক্ষই লাভবান হয়। অনুষ্ঠানটি আসামের শিলচরে হলেও এতে আসামের মুখ্যমন্ত্রী, আসামের গভর্নর উপস্থিত ছিলেন না। এর বিপরীতে মিজোরামের গভর্নর ছিলেন- এ রকম পরিস্থিতিতে এটি কতটা সফল হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাতে কী হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ছিলেন। গুজরাতের ভোটের কারণে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। পাশাপাশি মিজোরামের গভর্নরের থাকাটাই প্রমাণ করে উত্তর-পূর্ব ভারত ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশকে। ধীরে ধীরে এর সুফলও পাওয়া যাবে।

এই প্রসঙ্গটি টেনে এনে অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা শিলচরের সংসদ সদস্য ডা. রাজদ্বীপ রায় বলেছেন, দুইদিনের অনুষ্ঠানে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। ইতিহাসকে রোমন্থন করেছেন। বর্তমানকে যাচাই করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নতুন থেকে নতুন দিনে যাচ্ছে। এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। তার মতে, দুই দেশ একসঙ্গে যত কাজ করবে তত অর্থনীতির নতুন দুয়ার খুলবে। নদীপথ খুলে দিতে হবে। তাতে অর্থনীতি আরো চাঙা হবে।

অনুষ্ঠানে আসাম রাজ্য সরকারের বাণিজ্য ও পরিবহনমন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি বলেন, করিমগঞ্জের মহিশাসন পর্যন্ত ভারতের অংশে রেললাইনের কাজ শেষ হয়ে যাবে চলতি মাসেই। বাকিটা বাংলাদেশের দায়িত্ব। সে দেশে কাজ শেষ হয়ে গেলে রেলযোগাযোগ চালু হতে তেমন কেনো সমস্যা থাকবে না। তাই কাজে গতি আনতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জল, স্থল এবং আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দুই দেশের বাণিজ্য স¤প্রসারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়ে মিজোরামের রাজ্যপাল কে হরিবাবু বলেন, ইউএস ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ‘রুপি ট্রেডিং’ চালু করার ওপর জোর দিচ্ছে ভারত। এই বিষয়টির ওপর চিন্তাচর্চা করতে পারে উভয় দেশ। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, অপরিশোধিত তেলের আমদানি কমাতে আখ এবং দানাশস্য

থেকে ইথানল উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন এবং সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপরও জোর দিয়েছে সরকার। যেহেতু দানাশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অগ্রণী, তাই চাল থেকেও ইথানল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে তারা। এবং এই দুটি ক্ষেত্রেই একে অপরের সহযোগী হতে পারে ভারত-বাংলাদেশ। বক্তব্যে দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য গড়ে তোলার ওপরও জোর দেন তিনি। বলেন, এটা হয়ে গেলে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের শিল্পপতিরা উৎসাহিত হবেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিং শিলচরের সঙ্গে নাড়ির টান রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আমি মণিপুরের মানুষ। শিলচরসহ বরাক উপত্যকার সঙ্গে এক আত্মার সংযোগ রয়েছে সিলেটের। এই উৎসবের মাধ্যমে সংযোগ আরো গাঢ় হলো। এরপরই তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে অনুরোধ করে বলেন, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, অচিরেই শিলচরে বাংলাদেশের একটি ভিসা কার্যালয় স্থাপন করুন।

বাংলাদেশ সরকারের তরফে শিলচরে একটি ভিসা অফিস খোলার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ সীমান্ত হয়ে শিলচর-সিলেট বাস পরিষেবার প্রস্তাব দিয়েছেন ভারত সরকারের কাছে। শুধু তাই নয়, গুয়াহাটি থেকে সিলেট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত সরাসরি বিমান পরিষেবা চালুরও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। দুই দেশের বাণিজ্য স¤প্রসারণে বাংলাদেশের জলপথ উন্মুক্ত করার কথাও উচ্চারিত হয়েছে তার কণ্ঠে। বলেছেন মহিশাসন হয়ে দুই দেশের রেল যোগাযোগের কথাও। শিলচরে ভিসা অফিস প্রসঙ্গে আব্দুল মোমেন বলেন, ভারতের ডোনার মন্ত্রী কিষাণ রেড্ডির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবার শিলচরে ভিসা অফিস চালু করা যায় কিনা, আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে বাংলাদেশ চায়, শিলচরে ভিসা অফিস হোক। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুর। তাই আমি চাই দুই দেশের মধ্যে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে ‘ভিসামুক্ত যাতায়াত’ চালু হোক। তিনি এও বলেন, আগামীতে দুই দেশের মধ্যে ভিসাফ্রি আসা-যাওয়া চালু হবে, এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী। কেননা, ইতোমধ্যে ভারত সরকারকে সে প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। শিলচর-সিলেট বাস পরিষেবা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই দেশেরই রাস্তাঘাট উন্নত। ফলে বাস পরিষেবা চালু করতে সমস্যা হবে না। তবে এর আগে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি আউটপোস্ট নির্মাণ করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি ভারত ও বাংলাদেশ- উভয় সরকারকেই প্রস্তাব দেবেন। তার দাবি, বাস পরিষেবা চালু হলে বাণিজ্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হবে। দুই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে। দুই দেশের মধ্যে ‘ক¤িপ্রহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা)’ স্বাক্ষর নিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, এটা হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। বিষয়টি ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছে। বাংলাদেশে সেই চুক্তির খসড়া তৈরি করছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, শুধু বাংলাদেশের উন্নয়ন হলে হবে না। আশপাশের সব কটি দেশ এবং অঞ্চলের উন্নয়ন হতে হবে। সবার উন্নতি হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই হবে। তাই বাংলাদেশ চায়, আঞ্চলিক শান্তি, সৌহার্দ্য এবং স্থিতিশীলতা। তবে শুধু রাজনৈতিক স্তরে এই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব বলেছেন, ব্যবসার আগে এই অঞ্চলের মধ্যে পর্যটক বাড়ানো দরকার। এজন্য বরাক নদীর ওপর করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ সীমান্তে একটি সেতু নির্মাণের দরকার। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু নামে এটি নির্মাণ করলে দুই অঞ্চল উপকৃত হবে।

অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া জাতীয় সংসদের হুইপ ও সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম বলেছেন, এই অনুষ্ঠানে ভবিষ্যতের চিন্তাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চল যেমন উন্নত হবে তেমনি সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ দূর হবে। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হলে ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে অপশক্তি দূরে থাকে। অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া আরেক সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ বলেন, এত বছর পর এসে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিলচর-সিলেটের মিলন হলো। এতে দুই অংশই লাভবান হবে। তার মতে, আগামী বছর সিলেটে এই উৎসব হবে। তবে তার আগে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে দিনে বহু লোক যাতায়াত করবে। এতে আর্থিকভাবেও এই এলাকা লাভবান হবে। আরেক সংসদ সদস্য মহিবুর মানিকও শিলচরের সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ বাড়াতে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এতে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ই সুফল নেবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App