×

জাতীয়

নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:২৬ এএম

নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ

ছবি: সংগৃহীত

‘সোনালী ওয়েব’ নামের ছাপাখানা থেকে প্রাথমিক স্তরের একটি লটে ২ লাখ ৬১ হাজার ৩৮১টি পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয়ার কথা। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ওই ছাপাখানা মাত্র ৪৫ হাজার বই ছেপেছে। একই ছাপাখানা আরেকটি লটে ২ লাখ ২৯ হাজার ৬৯৫টি পাঠ্যবই ছাপার বরাত পেয়েছিল। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এই লটের একটি বইও ছাপতে পারেনি ওই ছাপাখানা। একইভাবে ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেস’ নামের আরেকটি ছাপাখানা ৫ লাখ ৬২ হাজার ২২৩টি পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয়ার কাজ পেয়েছিল। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ৯৫ হাজার ৯২টি পাঠ্যবই ছাপতে পেরেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই ১৭ দিন পর আগামী ১ জানুয়ারি দেশজুড়ে পাঠ্যপুস্তক (বই) উৎসব পালন করার নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের হাতে অর্ধেক বই দিয়েও বই উৎসব বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হবে। এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নমানের কাগজেই আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অন্তত ২০ কোটি পাঠ্যবই ছাপার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে এনসিটিবি। নবম শ্রেণির পাঠ্যবই আপাতত ছাপা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে এনসিটিবি। মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় ১২ কোটি বই ছাপা শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হবে। জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক লুৎফুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এবারো বই উৎসব হবে। উৎসবের জন্য প্রয়োজনীয় বই কি প্রস্তুত হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী ১ জানুয়ারির আগে সারাদেশে বই পৌঁছে যাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, পাঠ্যবই নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী এখন যেভাবে তত্ত্বাবধান করছেন সেটিই যদি তিনি গত জুন-জুলাই মাসে করতেন তাহলে বছরের শেষে এসে পাঠ্যবই ছাপানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সভা করার প্রয়োজন হতো না। সংকটের কথা জেনেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঠিক সময়ে যথাযথ নির্দেশনা না পাওয়ায় পাঠ্যপুস্তকসংক্রান্ত এনসিটিবির প্রত্যেকটি কাজে দেরি হয়েছে। আর এই দেরির ফলে শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই পৌঁছাবে না। যে কটি বই পৌঁছানো যাবে তাও অত্যন্ত নিম্নমানের। অতীতে এমন নিম্নমানের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীরা পায়নি। সব মিলিয়ে নির্বাচনের বছরে এসে পাঠ্যবই নিয়ে সরকার বিব্রত হচ্ছে। মূলত সরকারকে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর মাঠে নেমেছে। সংকটের কথা স্বীকার করে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সম্প্রতি বলেছেন, বর্তমানে পাঠ্যপুস্তক তৈরিতে কাগজের সংকট দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিকভাবে এ সংকট রয়েছে। এখন কাগজের দাম বেড়েছে। আমাদের কারণেও কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে এটি নিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে না। আমরা আশা করি, যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারব। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল সেটি নিরসনে মাস দেড়েক আগে মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একটি সভা হয়। সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। দীর্ঘ ওই সভায় অনেকে অনেক কথা বলার পর মুখ্যসচিব সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, যেভাবেই হোক আগামী ১ জানুয়ারি দেশে পাঠ্যপুস্তক উৎসব হবে। এরপরেই সিদ্ধান্ত হয়, ১ জানুয়ারি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মোট ৬টি বইয়ের পরিবর্তে ৩টি বই এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে মোট ১০টি বইয়ের পরিবর্তে ৪/৫টি বই তুলে দেয়া হবে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীরা পাবে। এসব বই ছাপাতে বইয়ের কাগজের ব্রাইটনেসও কমিয়ে দেয়া হবে। পাশাপাশি প্রাথমিকের বইগুলো যেসব ছাপাখানা ছাপিয়ে দেবে তাদের টাকা এনসিটিবি থেকেই দিয়ে দেয়া হবে। মূলত এমন সিদ্ধান্তের পরেই পাঠ্যবই ছাপা কাজের জটিলতা নিরসন হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, মূলত প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের চাহিদা এবং সরবরাহ ১ জানুয়ারিকেন্দ্রিক থাকে। নবম শ্রেণিতে উঠে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য নামে বিভাগ নির্বাচন করে। বিভাগ নির্বাচন করে ক্লাস শুরু করতে তাদের কিছুটা দেরি হয়। এজন্য নবম শ্রেণির পাঠ্যবই একটু পরে হলেও সমস্যা নেই। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে এনসিটিবি নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই ছাপানোর পর নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, গত সোমবার থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ বন্ধ রয়েছে। ছাপাখানার মালিকদের এনসিটিবি থেকে বলা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বই ছাপানোর কাজ শেষে নবম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ শুরু করবেন। আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এনসিটিবি সাধারণত বছরের জুন-জুলাই মাসে পাঠ্যপুস্তকসংক্রান্ত সব কাজের অনুমোদন দেয়। কিন্তু এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমিতে এনসিটিবি সময়মতো কাজগুলোর অনুমোদন দিতে পারেনি। এই ঢিলেমি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সবকিছু টালমাটাল হয়ে যায়। বাজারে যুক্ত হয় কাগজ সংকট। কোনোরকমভাবে এসব মোকাবিলা করে সামনে এগোতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আবারো সংকট তৈরি হয়। অথচ এসব যদি আগেভাগে মেটানো যেত তাহলে পাঠ্যবই নিয়ে আজ এই সংকটেই পড়ত না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এখন প্রাথমিকের বই ছাপায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ প্রাথমিকের বইয়ের সাইজ কিছুটা ছোট। এগুলো ছাপতে কম সময় লাগছে। তাছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও প্রাথমিক- দুই স্তরের বই ছাপার কাজ পেয়েছে তাদের প্রাথমিকের বই ছাপায় বেশি গুরুত্ব দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ মাধ্যমিকের কিছু বই ছাপতে কিছুটা দেরি হলেও সমস্যা নেই। নতুন বছরের শুরুতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সবাইকে নতুন বই দেয়া হবে। ছাপাখানা মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩৫ কোটি বই ছাপতে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন কাগজ প্রয়োজন। কিন্তু ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, গ্যাস সংকট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে এমনিতেই দেশে ভালো মানের কাগজের সংকট প্রকট। কাগজের কাঁচামালের সংকটের অজুহাতে বেশির ভাগ কাগজের মিল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাজারে কাগজের সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে ছাপাখানা মালিকদের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে নিউজপ্রিন্ট কাগজের উৎপাদন বন্ধ রেখে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাগজ উৎপাদনে জোর দিতে পদক্ষেপ নিতে আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানিতে ৭ শতাংশ শুল্প মওকুফের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দরপত্রের শর্তে উন্নত মানের অর্থাৎ ‘ভার্জিন পাল্পযুক্ত’ কাগজে বই ছাপার কথা বলা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বই ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা ভার্জিন পাল্প থাকতে হয়। এই পাল্প ছাড়া কাগজে উজ্জ্বলতা ঠিকমতো আসে না বলে এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে এই শর্ত কিছুটা শিথিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তোফায়েল খান বলেন, দেশে এই মুহূর্তে মাত্র দুটি মিলে ৮০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন হয়। বাকি সব মিলই নিউজপ্রিন্টের মতো ৭০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন করছে। কিন্তু বেশি টাকা দিয়েও বাজারে ৭০ জিএসএমের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ছাপাখানাগুলোর কিছু করার নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App