×

সাহিত্য

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:২৭ পিএম

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন

ছবি: ভোরের কাগজ

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে হানাদার পাকিস্তানিরা। জাতিকে মেধাশূন্য করার চক্রান্তে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বিজয়ের মাত্র একদিন আগে দেশবরেণ্য এই বুদ্ধিজীবিদের হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে নেমে আসে এক কালো অধ্যায়। দুঃখ জাগানিয়া দিনটিতে শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথায় মূর্ত হয়ে উঠে। আলোচনা, নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটকসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বুধবার বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করেছে সংস্কৃতিকর্মীরা। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে গান, আবৃত্তি, নাচের মাধ্যমে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। বিকাল ৫টায় উদীচী চত্বরে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে” এবং “মুক্তির মন্দির সোপান তলে” গান দুটি সমবেতভাবে পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এরপর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। এ পর্বের শুরুতে আলোচনা করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনির তন্ময়। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডেরও বিচার শুরু হয়। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই রায় কার্যকরের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়া, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সমাজের প্রগতিশীল মানুষদের আহ্বান জানান আসিফ মুনির তন্ময়। আরো বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, সহ-সভাপতি নিবাস দে, হাবিবুল আলম, প্রবীর সরদার এবং জামসেদ আনোয়ার তপন। আলোচনা পরবর্তী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করে মায়েশা সুলতানা উর্বী, অনিমা সায়মা, সোনিয়া আক্তার এবং আনিকা মাহমুদ রীমা। এছাড়া, আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য শিখা সেন গুপ্তা এবং বাড্ডা শাখার বাচিক শিল্পী মরিয়ম বেগম তৃষা। শেষে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এর আগে, সকাল সাড়ে সাতটায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ অর্পন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর সংসদের নেতৃবৃন্দ। জাতীয় জাদুঘর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক সেমিনার ও আলোচনাসভার আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর জাদুঘর। কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনের এই আয়োজনে মূল বক্তব্য প্রদান করেন জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। বাঙালি জাতি যখন বিজয়ের খুব কাছে, ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করে। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। মূলত পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করাই ছিল পৈশাচিক হত্যাক্যান্ডের উদ্দেশ্য। স্বপ্নকুঁড়ি গণসংগীতের মধ্য দিয়ে শহীদ বুুদ্ধিজীবী দিবস পালন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বপ্নকুঁড়ি। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ বাঙলা’ শিরোনামের এই আয়োজন। এতে একক কণ্ঠে গণসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী হাসান মাহমুদ। অনুষ্ঠানে শিল্পী পরিবেশন করেন আমি এক যাযাবর, নাম তার ছিল জন হেনরি, দোলা হে দোলা, মোর গাঁয়ের সীমানায় পাহাড়ের ওপারে, ডিম পাড়ে হাঁসে খায় বাগদাসে, ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে, মাগো ভাবনা কেন, ছোটদের বড়দের সকলের ইত্যাদি গানগুলো পরিবেশন করে অনুষ্ঠানে আগতদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়ান এই গণসংগীত শিল্পী। বাংলা একাডেমি নানা আয়োজনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করেছে বাংলা একাডেমি। বিকাল সাড়ে ৩টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনের এই আয়োজনে ‘জাতিসত্তার বিনাশ ও বুদ্ধিজীবী উৎসাদন’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। আলোচক ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার পুত্র প্রকৌশলী রবিউল আফতাব। এতে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। মফিদুল হক বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনকালে আমরা বড় পরিসরে দেখতে চাইবো বুদ্ধিজীবী উৎসাদনের ঘটনাধারা। এর থেকে আমাদেরকে নিতে হবে ইতিহাসের শিক্ষা। দীর্ঘ বিলম্বে হলেও বুদ্ধিজীবী নিধনের কতক ঘটনার বিচার আমরা সম্পন্ন করতে পেরেছি। এতে কেবল ঘাতকদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়নি, বরং ইতিহাসের রায়ও আমরা অর্জন করেছি। তিনি আরও বলেন, বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনাকে আমাদের দেখতে হবে বড় পটভূমিকায়। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী সামরিক অভিযান কেবল সূচনা করেনি, বাঙালি জাতিসত্তা ধ্বংস করতেই পরিচালিত হয়েছিল এই অভিযান। এর আগে সকাল সাড়ে সাতটায় রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুরস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বাংলা একাডেমি। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমিও নানা আয়োজনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করেছে। শিল্পকলা একাডেমি মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও দেশের গানের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্মরণ করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সন্ধ্যায় একাডেমির নন্দন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের পোস্টার প্রদর্শনী। আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর এবং প্রধান আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব সালাউদ্দিন আহম্মদ। আলোচনা পর্বের পর অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, একক সংগীত ও সমবেত সংগীতের মাধ্যমে এ শহীদদের স্মরণ করা হয়। কবিতা পাঠ করেন কবি নুরুল হুদা, রুবি রহমান, ড. মুহাম্মদ সামাদ, মিনার মনসুর এবং ড. লায়লা আফরোজ। ‘সুন্দর সুবর্ণ ’,‘মাগো ধন্য হলো’, ‘বঙ্গবন্ধুর লাগিয়া’, ‘যে দেশেতে শহীদ মিনার’,‘ও আমার জন্মভুমি’,‘আমি তোমার জন্য’ শিরোনামে একক সংগীত পরিবেশন করেন যথাক্রমে সূচিত্রা রাণী সুত্রধর, হিমাদ্রী রায়, রোকসানা আক্তার রুপসা, মেহেক, হিরক সরদার এবং ইয়াসমিন আলী। ‘ও আলোর পথযাত্রী’ শিরোনামে ইয়াসমিন আলীর পরিচালনায় সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন ঢাকা সাংস্কৃতিক দল। মুক্তিরও মন্দিরও সোপান তলে, নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, ভেবোনা গো মা তোমার, কাদোঁ বাঙালি কাদোঁ এবং মরণ সাগর পাড়ে শিরোনামে সমবেত সংগীত (কোলাজ) পরিবেশন করেন ঢাকা সাংস্কৃতিক দল। সকালে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে কবিতা পাঠ করেন কবি নূরুল হুদা, কবি শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, কবি আসলাম সানি, ফারুক মাহমুদ এবং কবি শাকিরা পারভীন। আবৃত্তিতে ছিলেন গোলাম সারোয়ার, মিজানুর রহমান সজল, ফয়জুল্লাহ সাঈদ, কাজী বুশরা আহমেদ তিথি এবং মাহমুদা আক্তার, কবি শিহাব সরকার, কবি টোকন ঠাকুর, কবি ঝর্ণা রহমান, কবি শিহাব শাহরিয়ার এবং কবি ওবায়েদ আকাশ। আবৃত্তিতে ছিলেন লায়লা তারান্নুম, মীর বরকত, রেজিনা ওয়ালী লিনা, ইকবাল খোরশেদ, শামীমা চৌধুরী এলিস এবং মাসুদ মান্নান। সংগীত পরিবেশনায় ছিলেন মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া, নুরজাহান আলীম, রাজিয়া সুলতানা মুন্নি এবং নবীন কিশোর গৌতম। সংগীত পরিবেশন করেন শিবু রায়, ছন্দা চক্রবর্তী, মিমি আলাউদ্দিন, আজগর আলী, আহসান উল্লাহ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App