×

জাতীয়

শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করার দিন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:৩০ এএম

শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করার দিন

ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়িতে থাকতেন তিনজন মানুষ। তার মা, পুত্র সুমন আর ভাই উজিরউদ্দিন। সেদিন শীতের সকালে সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। বাড়ির উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামল। সেই বাসার প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে কিছু আলবদর কর্মী। তাদের সবাই একই রংয়ের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এক সময় সেলিনা পারভীনের ফ্ল্যাটে এসেও কড়া নাড়ে। নিজে দরজা খুলে দেন তিনি। লোকগুলোর সঙ্গে তার বেশ কিছু কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে ধরে নিয়ে যায়।

মোহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রায় ৩০ জনকে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিল ঘাতকরা। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন- শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরো অনেকে। সেখানে একমাত্র নারী বন্দি হিসেবে ছিলেন সেলিনা পারভীন। ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় রায়েরবাজারের বটতলায়। লম্বা রশি দিয়ে ৩০-৪০ জনকে সোজা লাইনে দাঁড় করিয়ে হাত বাঁধা হয়। সেখানে বেয়ানেট চার্জ ও গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর তাদের ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই মহান এ জাতিকে পঙ্গু করার এক অপচেষ্টা করে যায় পাকিস্তানি সেনারা। বাঙালিদের বিজয় অবশ্যসম্ভাবী বুঝতে পেরে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে এক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তারা। জাতিকে চিরতরে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দেয়ার লক্ষ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবী ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়। সশস্ত্র সংগ্রামের শেষ মুহূর্তে বাড়ন্ত বাতাসে পাল যেমন নৌকাকে এগিয়ে নেয়; তেমনি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ে স্বাধীনতার পূর্বাভাস দিচ্ছিল। ঠিক তখনই অন্য প্রান্তে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্ত গঙ্গা বয়ে গেছে। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন। ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ সেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

শুধু স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তেই তাদের হত্যা করা হয়েছে তা নয়। তাদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানো হয় ২৫ মার্চ রাত থেকেই। পাকিস্তানিদের এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যই ছিল রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এসব ব্যক্তিরাই স্বাধীনতার পথকে বিভিন্নভাবে সুগম করেছিলেন। ২৫ মার্চের রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও শিক্ষকদের কোয়ার্টারগুলোতে ভয়ংকর আক্রমণ করে যাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন- অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, এ এন এম মুনিরুজ্জামান, মুহম্মদ আবদুল মুকতাদির, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, আতাউর রহমান খান খাদিমসহ আরো অনেকে। মার্চে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্নিকাণ্ডে দৈনিক সংবাদ অফিসের ভেতরে আগুনে পুড়ে মারা যান শহীদ সাবের। এ মাসেই কবি মেহেরুন্নেসা ঘাতকদের হাতে নিহত হন।

এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীরা দেশ-জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার। জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ দেয়াসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ২৫ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়েই বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। তবে বিজয়ের প্রাক্কালে এ হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ নেয়। দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ছিল জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাঙালি জাতি এখনো তার সূর্যসন্তানদের হারানোর শোক হৃদয়ে ধারণ করে চলেছে।

আর দলমতনির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মৌলবাদী চক্রের রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রবিরোধী সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মৌলবাদীচক্র একাত্তরে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চালায়। মুক্তমনা, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। এই সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে দেশব্যাপী আগুন সন্ত্রাস চালায়, মানুষ খুন করে এবং পরিকল্পিত নাশকতা চালায়। এখনো নানাভাবে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। বাণীতে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

কর্মসূচি : প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে আওয়ামী লীগ। সূর্যোদয় ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ করা হবে। সকাল ৭টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো, সকাল সাড়ে ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে দিবসটি পালনের জন্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সবস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক, সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App