×

জাতীয়

গুলির সেই বিকট শব্দ আজও কানে বাজে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৩৬ এএম

গুলির সেই বিকট শব্দ আজও কানে বাজে

ঘড়িতে তখন রাত বারোটার কাছাকাছি। হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দ। দরজা খোলার আগেই পেছন দরজা থেকে রুমে তিনজন পাকিস্তানি সৈনিকের প্রবেশ। ভ্রু কুঁচকানো চোখে প্রশ্ন, ‘প্রফেসর কাহা হে?’ মা এগিয়ে গিয়ে বললেন, কেন, কী দরকার? উত্তর এলো, উনকো লে জায়েঙ্গা। তারপর বাবার কাছে এসে বলল, আপকা লে জায়েঙ্গা। বাবা বলল, হোয়াই? কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারা বাবাকে টেনে হিঁচড়ে দরজার বাইরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে গুলির বিকট শব্দ! নিচে গিয়ে দেখি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাবা পড়ে আছেন, ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। গুলির সেই শব্দ আজো কানে বাজে। এভাবেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাবার ওপর নৃশংস অত্যাচারের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি তৎকালীন ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মেয়ে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সেসময় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। পরিবারসহ থাকতেন ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার পাড়া এলাকায়। সেদিনের ঘটনায় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় ৩৬ ঘণ্টার মতো বিনা চিকিৎসায় বাসায় ছিলেন। এরপরে ২৭ মার্চ সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। গুরুতর আহত হওয়ায় তিনি ৩০ মার্চ হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন।

২৫ মার্চ রাতের বর্বরতার বর্ণনায় অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা আরো বলেন, বাবাকে টেনেহিঁচড়ে নেয়ার সময় দেখি আমাদের বিল্ডিংয়ের তিনতলা থেকে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক এ এন এম মুনীরুজ্জামান ও তার নিজের ছেলেসহ তিনজন ছেলেকে নিচে নামাচ্ছে সেনারা। আমি সবাইকে জানানোর জন্য ফোন করতে গিয়ে দেখি ফোন লাইন কাটা। বিষয়টা এসে মাকে বলব অমনি কয়েকটা গুলির বিকট শব্দ হলো। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখলাম মুনীরুজ্জামানসহ তার ছেলেদের হত্যা করেছে। একজন সৈনিক বলল, আপনার বাবাকেও গুলি করেছে, তিনি নিচে পড়ে আছেন। বাবাকে গিয়ে দেখি পড়ে আছে। তবে তিনি পুরোপুরি সজাগ ছিলেন। তিনি আমাদের বর্ণনা করলেন, ‘আমাকে দাঁড় করিয়ে নাম জিজ্ঞেস করেছে,ধর্ম জিজ্ঞেস করেছে। ধর্ম বলাতে তারা বলছে গুলির অর্ডার এসেছে। তারা আমাকে দুটো গুলি করেছে।’ একটা ঘাড়ে আর অন্যটা কোমড়ে। কোমড়ের গুলিতে নিচের অংশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। আর ঘাড়ের গুলিটা বিঁধে বের হয়ে গেছে। গুলিতে বাবা শরীরটা নাড়াচাড়া করতে পারছিল না। সৈনিকরা চলে যাওয়ার পরে আমরা বাবাকে ভেতরে নিয়ে গেলাম। ২৭ তারিখে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এবং ৩০ তারিখ বাবা মারা যান।

এরকম অনেক ঘটনাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে। নাম জানা, না জানা অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী শহীদ হয়েছেন। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে এসে দেশের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ পরিবারদের নিয়ে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহিদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাজী মিন্নত আলী বলেন, ১৪ ডিসেম্বর এলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের স্মরণ করে, কিন্তু আমাদের সেভাবে মূল্যায়ন করে না। ১৯৯৬ সালের দিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এখনো প্রত্যয়নপত্র দেয়নি। উল্লেখ্য, হাজী মিন্নত আলীর বাবা হাফিজ উদ্দীন রোকেয়া হলের কর্মকর্তা ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক শহীদ হয়েছেন তাদের নাম কলাভবনের সামনে ও স্মৃতি চিরন্তন নামফলকে লেখা আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক শহীদ হয়েছেন তারা হলেন- বাংলা বিভাগের আনোয়ার পাশা, মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও এমএমএ রাশিদুল হাসান; ইতিহাস বিভাগের গিয়াস উদ্দিন আহমদ, মো. আবুল খায়ের ও সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য; শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের আ ন ম ফয়জুল মহী, মো. সাদত আলী ও সিরাজুল হক খান; ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য; পরিসংখ্যান বিভাগের এ এন এম মুনীরুজ্জামান; ভূতত্ত্ব বিভাগের এম এ মুক্তাদির; দর্শন বিভাগের গোবিন্দ চন্দ্র দেব; মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ফজলুর রহমান খান; পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আতাউর রহমান খান; গণিত বিভাগের সরাফত আলী, বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা।

উল্লেখ্য, যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন উপলক্ষে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলন, উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিয়াসহ বিভিন্ন হল মসজিদ ও উপাসনালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জন্য প্রার্থনাসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App