×

জাতীয়

অস্থিরতায়ও চাঙা দেশের পোশাক খাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০৩ এএম

অস্থিরতায়ও চাঙা দেশের পোশাক খাত

ফাইল ছবি

চীন থেকে স্থানান্তর হয়ে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে স্থগিত রপ্তানি আদেশ ও নতুন ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে

বিশ্বের প্রায় সব জায়গায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে সব দেশের ভোক্তাই চাপে পড়েছেন। এর মধ্যেও চাঙা রয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে ভর করে রপ্তানিতে সুবাতাস দেশের অর্থনীতির জন্যও স্বস্তি বয়ে এনেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাকের সুবাদে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। নভেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫শ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। যা স্বাধীনতার পর এই প্রথম বলে জানিয়েছে ইপিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র।

এদিকে সাম্প্রতিক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা অনুসারে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশ আবারো দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় অবস্থানে; সেবার বাংলাদেশের আগে ছিল ভিয়েতনাম। স্থগিত হওয়া রপ্তানি আদেশ আসতে শুরু করা এবং আগের বানানো পোশাক ক্রেতারা নিতে শুরু করা, পাশাপাশি কাঁচামালের বর্ধিত দামের কারণে নভেম্বরে রপ্তানিতে এ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারক ও ইপিবির সংশ্লিষ্টরা। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, পোশাক খাতে চাঙা ভাব দেখা গেলেও সংকট এখনো কাটেনি।

জানা গেছে, শীর্ষ রপ্তানিকারক চীন এখনো কোভিডসৃষ্ট লকডাউন থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে না পারায় ক্রেতাদের অর্ডার স্থানান্তর করার প্রবণতাও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। টানা তিন মাস তৈরি পোশাকের অর্ডার কমতির দিকে থাকার পর নভেম্বর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি দেখতে শুরু করেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা। কিছুটা দেরিতে হলেও শীত মৌসুমের পর বসন্ত মৌসুমের পোশাকের অর্ডারের ইনকোয়ারি আসতে শুরু করেছে, যা অর্ডারের প্রাথমিক ধাপ। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাবের সময় এই প্রবণতাকে আশার আলো হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে আগে স্থগিত করা কিংবা শিপমেন্ট না করতে বলা পণ্যও ত্রেতারা এখন নিতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন আরএমজি রপ্তানিকারকরা।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত বেশি হারে বেসিক আইটেমের পোশাক তৈরি করে, যার চাহিদা অন্যান্য ভ্যালু অ্যাডেড পোশাকের তুলনায় বেশি। এছাড়া শীর্ষ রপ্তানিকারক চীনের এখনো কোভিডসৃষ্ট লকডাউন থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে না পারায় ক্রেতাদের অর্ডার স্থানান্তর করার প্রবণতাও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নভেম্বর মাসের প্রথম ২০ দিনে পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। অক্টোবরের পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ভোরের কাগজকে বলেন, গত দুই-তিন মাসের তুলনায় অর্ডারের জন্য ইনকোয়ারি বেড়েছে। এছাড়া আগের তৈরি হওয়া পণ্য কিংবা অর্ডার হলেও তা স্থগিত (হোল্ড) করতে বলা পণ্য এখন ক্রেতারা নিতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, চায়না থেকে ক্রেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়াও আমাদের জন্য সুখবর বয়ে এনেছে। তবে আগামীতে পোশাক খাতের সুদিন আসছে, এটা বলা যাবে না। কারণ ইনকোয়ারি আসছে। এরপর ক্রয়াদেশ আসবে, দাম নির্ধারণের বিষয় আছে। অর্থাৎ আগামী জানুয়ারির শেষে এ বিষয়ে বোঝা যাবে। তবে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এতদিন অর্ডার কম থাকায় গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট থাকলেও তা খুব একটা চোখে পড়েনি। নিজেদের ক্ষতি হলেও ক্রেতার কাছে সুনাম নষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন অর্ডার বাড়তে শুরু করলে গ্যাস-বিদুতের সংকটের কারণে যদি সময়মতো পণ্য দিতে না পারি, তাহলে নিজের ক্ষতির পাশাপাশি ক্রেতার কাছে সুনামও নষ্ট হতে পারে।

আগের তৈরি হওয়া পণ্য কিংবা অর্ডার হলেও তা হোল্ড করতে বলা পণ্য এখন ক্রেতারা নিতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন দেশের অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর পরিচালক মো. খসরু চৌধুরী। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, নভেম্বর মাসে রপ্তানির যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে তা মূলত পুরনো অর্ডারকৃত পণ্য।

তিনি আরো বলেন, গত বছর করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর কারণে অনেক ক্রয়াদেশ থাকলেও তা স্থগিত ছিল। ক্রেতাদের মধ্যেও এক ধরনের নেগেটিভ মনোভাব ছিল। সামনে বড়দিন ও শীতকালকে কেন্দ্র করে ক্রেতারা তাদের স্থগিত পণ্য নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফলে রপ্তানি বেড়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আবার কিছুটা কমার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন করে ক্রয়াদেশ বাড়েনি; বরং কমেছে।

খসরু চৌধুরী বলেন, নতুন ক্রয়াদেশ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম আছে। আমাদের নতুন ক্রয়াদেশ নেই বললেই চলে। গত বছরের স্টক যা ছিল তাই রপ্তানি করেছি। বর্তমানে যে ক্রয়াদেশ আছে তা দিয়ে ৮ ঘণ্টা চালানো সম্ভব হচ্ছে। যা আগে ১০ ঘন্টা করে চালাতাম।

তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিক সময়ে পোশাকের ক্রয়াদেশ জুলাই মাস পর্যন্ত ‘বুকড’ থাকে। তবে বর্তমানে বেশির ভাগ কারখানায় মার্চ মাস পর্যন্ত আছে। এরপর কোনো অর্ডার নেই। অর্থাৎ মার্চের পর এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে।

প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিটওয়্যারের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১১ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ওভেন পোশাক থেকে আয় ৮২১ কোটি মার্কিন ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। একক মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের ৩২৩ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২০২২ সালের একই মাসে ৩৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৪৩৭ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের কাগজকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট রয়েছে। আবার অর্ডার নিয়ে আলোচনা হলেও মূল্য কম দিতে চাচ্ছে ক্রেতারা। সেজন্য হিসাব করেই অর্ডার নিচ্ছি। তিনি বলেন, পোশাকের বড় বাজারগুলো মূলত চারটি মৌসুম হিসাব করে পণ্য কিনে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম বড় মৌসুম শীতের পণ্য রপ্তানি প্রায় শেষের পথে। এখন বসন্ত মৌসুমের অর্ডার আসছে। এসব পণ্য জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে রপ্তানি করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল ভোরের কাগজকে বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাবে কাঁচামালের পোশাকের ইউনিটের দাম বেড়েছে এবং সেইসঙ্গে আগের মাসগুলোতে অর্ডার বেড়ে যাওয়া রপ্তানির পরিমাণ বাড়ার কারণ হতে পারে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হতাশাজনক বলে মনে হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী খুচরা ব্যবসা একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই এ ধরনের রপ্তানি বৃদ্ধিকে আত্মতুষ্টির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। আমরা সতর্ক এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাবাদী। কারণ পোশাক শিল্পটি একটি টেকসই শিল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।

সর্বশেষ ডব্লিউটিওর বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা অনুসারে, ২০২১ সালে তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক রপ্তানির ৮ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে; যার মূল্য ৩৫৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের অংশ ২০২০ সালের ৬.৪% থেকে ২০২১ সালে ৫.৮% এ নেমে এসেছে।

বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, এতদিন অর্ডার কম ছিল, এখন কিছুটা বাড়ছে। আবার অতীতে বর্ধিত কাঁচামালে তৈরি হওয়া পোশাক নভেম্বরেও রপ্তানি হয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত হায়ার এন্ডের পণ্য রপ্তানিও বাড়িয়েছে। যেমন আগে হয়তো ২০ ডলারের পোশাকই বানাত বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। কিন্তু এখন ৩০ ডলারের পোশাকের অর্ডারও নিচ্ছে, এটিও রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করেছে বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্ব অর্থনীতি খারাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভালো অর্ডার আসার পেছনে চীন থেকে ক্রেতাদের সরে আসাকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, বেইজিংয়ে কোভিডের কারণে লকডাউন ছিল। আবার বৈশ্বিক রাজনৈতিক উত্তেজনাও রয়েছে। এসব কারণে ক্রেতারা অনিশ্চয়তার জন্য সেখান থেকে শিফট করছে, যার ভালো অংশ পাচ্ছে বাংলাদেশ। পোশাকের মূল কাঁচামাল তুলার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিও এর পেছনে একটি কারণ ছিল বলে মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App