×

মুক্তচিন্তা

শরণার্থী ও আমাদের নেকাবে ঢেকে রাখা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৩:৫১ পিএম

মিয়ানমার থেকে এককাপড়ে চলে আসা শরণার্থীদের নিয়ে আমাদের ভাবনার শেষ নেই; দিলে রহমের শিশিরবিন্দুও জমা হচ্ছে। চাল, ডাল, টাকা চাঁদা তুলছি—বাড়ির পুরোনো কাপড়চোপড় বিলিয়ে একই সঙ্গে ঘর পরিষ্কার আর সওয়াব কামানোর এমন মওকা কবে কখন আসে ঠিক নাই! আজকাল ‘ফকির-ফকরারাও পুরোনো কাপড় ধরে না, বুয়ারা ফিক্কা ফেলায়—আগে পুরোনো কাপড় দিয়ে হাঁড়িপাতিল মিলত’—এখন সেসব ইতিহাস। পুরোনো কাপড় নিয়ে বড় বিপাকে থাকা বড় বাপের বেটা-বেটিরা মহা খুশি ছিলেন; কিন্তু শরণার্থীরা পুরোনো কাপড় প্রত্যাখ্যান করায় তাঁরা প্রথমে মুষড়ে পড়েছিলেন পরে মারমুখী হয়েছেন—একজন মুখপঞ্জিতে যে স্থিতি দিয়েছেন তার বাংলা দাঁড়ায় এ রকম: ‘আপনাদের জানা উচিত, আমরা প্রতিবছর উত্তরের জেলাগুলোতে পুরোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করি। এখানকার মানুষেরা এসব কখনোই ফেলে দেয় না, বরং তারা আনন্দের সঙ্গেই নেয় এবং ব্যবহার করে। এখানে তারা এসব ফেলে দিচ্ছে। আপনারা যখন এর ব্যাখ্যা দেন, তখন অন্য বিষয়গুলোও আপনাদের ভেবে দেখা উচিত। যদি আমাদের মানুষেরা এসব ব্যবহার করতে পারে…’ এই বয়ান জাতিসংঘের একটি নামজাদা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ত্রাণকাজে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তার—মাঠের সিদ্ধান্ত এখন তাঁরাই দিচ্ছেন। বলে রাখা ভালো, ত্রাণ–সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সব বিধিমালায় পুরোনো কাপড় বিতরণকে চরমভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে; পাক্কা লন্ড্রি না করে এগুলো কোনো অবস্থাতেই বিতরণ না করার জন্য বলা হয়েছে। কথিত কর্মকর্তা শরণার্থীদের শাপান্ত করতে গিয়ে কিছু অসত্য তথ্য দিতে কসুর করেননি—উত্তরবঙ্গে পুরোনো কাপড় এখন আর কেউ দেয় না, মানুষও নেন না; তবে এটা ঠিক, কিছু কিছু আয়করমুক্ত প্রতিষ্ঠানের ফটকে নভেম্বর মাসের শেষ থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরোনো পিজবোর্ডের বাক্স বা কার্টুন রাখা হয় কর্মীদের বাড়ি পরিষ্কার, ঘর ঝাঁটানো পুরোনো কাপড় কালেকশনের মহান উদ্দেশ্যে। এটা একটা প্রথা, এতে যদি কর্মীরা দু-একটা কাপড় ফেলে মনের মধ্যে একটা দানবীর দানবীর বোধ নিয়ে চাঙা দিলে ঘোরাফেরা করার মওকা পায়, তাহলে ক্ষতি কী? কর্মীদের মনোভাব চাঙা রাখার জন্য মানবসম্পদ বা এইচআর দপ্তরের নানা তরিকার এটা এক তরিকা—লেট দেম ফিল বেটার—। কর্মী ভালো কাজ করার একটা ফিলিং নিয়ে বাতাসে উড়লে তারা অনেক চনমনে দিলে কাজ করবে—এটাই দুই পাতা পড়া কর্মী প্রশাসনের কর্তাদের ধারণা। তার বলি হয় প্রান্তিক মানুষেরা; ত্রাণ যে দান-খয়রাত নয়, এটা যে মানুষের অধিকার, তা আমরা মুখে বলি, আমল করি অন্য কিছুর। কেউ লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের এখনই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা উচিত।’ এ কেমন কথা? তাদের প্রজননপ্রথা বা সংস্কৃতি বাতলে দেওয়ার আমি কে? আমাদের দাদা-নানাদের চেয়ে আমাদের সন্তানসংখ্যা কম কেন? আমাদের পিতা-পিতামহরা কি অশিক্ষিত ছিলেন? আমরা কি বেশি শিক্ষিত? মানুষের সন্তান নেওয়া বা না-নেওয়ার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। এর কোনোটি নৃতাত্ত্বিক, কোনোটি অর্থনৈতিক, কোনোটি রোগবালাইয়ের মৃত্যুঝুঁকি, আবার কখনো সামাজিক, উত্তরাধিকার নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া (ভ্রাতাহীন পরিবারে পিতার সম্পত্তির দখল নেওয়ার জন্য বোনদের মধ্যে পুত্রসন্তানের প্রতিযোগিতাও এই উপমহাদেশে আকছার হচ্ছে) এসব হাজারটি কারণ থাকতে পারে; সবচেয়ে বড় কথা, কৃষিভিত্তিক সমাজে পরিবারের সদস্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করে হালের সংখ্যা, জমির পরিমাণ ইত্যাদি আরও কত কী? নানা কারণের আরেক কারণ খুঁজে পেয়েছেন একজন দিলদরাস্ত ত্রাণকর্মী। দেখি তিনি কী দেখলেন: ‘মাস দশেকের এক বাচ্চা কোলে, তারপরও সেই রোহিঙ্গা নারী প্রেগন্যান্ট। মেজাজ এমন খারাপ হলো! কিছুক্ষণ নীতিকথা শুনিয়ে দিলাম গরম গরম। জন্মনিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক যুগোপযোগী কম সন্তানের মর্ম বোঝালাম।’ তারপরও সেই নারীর কাছে কারণ শুনতে চাওয়ায় কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, ‘ভাই, পেট খালি থাকলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এসে নিয়ে যায়। একমাত্র পেটে সন্তান থাকলেই নিতে চায় না।’ শরণার্থীদের নিয়ে আমাদের আরও দুশ্চিন্তা আছে, তারা জঙ্গি, মাদক/ইয়াবা ব্যবসায়ী বা কালোবাজারি, ডাকাত, খুনি, বিচ্ছিন্নতাবাদী। শরণার্থীদের জন্য চাল-ডাল সংগ্রহকারী একজন চে ফিদেলের ছবি আঁকা গেঞ্জি পরা আধুনিক মানুষকে তাঁর প্রিয় মানুষের মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, আমরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যায় জর্জরিত, কেন এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নেওয়া? এসব চোর-ছ্যাচড় রোহিঙ্গাদের এভাবে সাহায্য করাটা ঠিক হচ্ছে না, এদের মধ্যেই দেখবা ঘাপটি মেরে আছে কত কত অপরাধী। সৌদি আরব থেকে একজন মুখপঞ্জি স্থিতি দিয়েছেন ইংরেজি জবানে। বাংলায় এ রকম, ‘আমি এখন পাঁচ সপ্তাহ ধরে সৌদি আরবে আছি। এবার নিয়ে এ বছর আমি দ্বিতীয়বার এখানে এসেছি। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এদের ও সংশ্লিষ্ট পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আমি পর্যবেক্ষণ করে জানলাম, এরা সৌদি সরকার ও জনগণের কাছ থেকে সব ধরনের সহায়তা পাচ্ছে। তারা আমাদের শুধু এই অনুরোধ করেছে যে আমরা যেন নিজে থেকে আরাকানের মানুষকে সহায়তা করি। ‘আমি বুঝলাম, এরা স্বদেশিদের জন্য একটা পয়সাও দেয়নি। বরং তারা এখানে গত কয়েক বছরে বসতি স্থাপন করছে, কাজে–কর্মেও এরা ভালো করছে। এমনকি তারা এখানে বাড়িও করেছে।’ শুধু সৌদি আরব নয়, পৃথিবীর নানা দেশে রোহিঙ্গা পরিচয়ে হাজার হাজার মানুষ সেসব দেশের নাগরিকত্ব বা রেসিডেন্সি নিয়েছে—এদের মধ্যে অল্প কিছুই প্রকৃত রোহিঙ্গা। তাহলে বাকিরা কী? নিচের কাহিনি থেকে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আমার এক বন্ধু লিখে জানিয়েছেন, ‘জার্মানিতে একটা বাঙালি পরিবারকে চিনতাম। ময়মনসিংহে বাড়ি। স্বামী, স্ত্রী আর তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন বহু বছর ধরে জার্মানিতে আছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। ইন্টারেস্টিং হলো, এরা সবাই রোহিঙ্গা পরিচয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলাম, সমুদ্রপথে কঠিন যাত্রা করে লিবিয়া হয়ে তারা ইতালিতে ঢুকেছিল। পরে এদের মধ্যে হাজারখানেক বাঙালি বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা সেজে এসাইলাম পেয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।’ না, এদের চুলে উকুন নেই, পেটে অসুখ নেই—এরা রিলিফ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে না। এদের চারটা করে বউ নেই, ৮-১০টা করে বাচ্চা নেই। জি, তারা ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান—এসব ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। মিডল ইস্ট আর ইউরোপ এদের নিয়ে নিয়েছে ২০ বছর আগে। বছর তিনেক আগে সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের বায়োমেট্রিকস পাসপোর্টের সমস্যা বোঝার জন্য সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে রোহিঙ্গা সেজে থেকে যাওয়া বাঙালিদের সংখ্যা গোনার সাহস হয়নি; দূতাবাসের লোকজন বলেছিলেন, রোহিঙ্গা হিসেবে বেশি সুযোগ নেওয়ার জন্য দলে দলে বাঙালিরা পাসপোর্টে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা সিল নিয়ে গেছে; তার মানে রোহিঙ্গাদের গরম তাওয়ায় আমাদের কেউ কেউ দিব্যি রুটি সেঁকে বা ভেজে নিচ্ছেন। আমাদেরও স্বার্থ আছে ষোলো আনা! আরেকটা প্রশ্ন, পরবাসী রোহিঙ্গারা রাখাইনে আটকে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা পাঠায় কোন পথে? কক্সবাজার-টেকনাফে ছাড়া তাদের কোনো রাস্তা নেই—ব্যাংক রেমিট্যান্স হোক আর হুন্ডি হোক, পথ একটাই—কক্সবাজার-টেকনাফ!! আখেরে লাভটা কার? জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ থাকবে, প্রশাসনের নাকের ডগায় ইয়াবা ব্যবসা হবে, আর সেই দায় রোহিঙ্গাদের? পাহাড়ের সেটেলারদের প্রশাসন তাদের ইচ্ছায় ব্যবহার করবে, সরকারযন্ত্র জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দিয়ে ফায়দা নেবে, সেই দায়ও রোহিঙ্গাদের? মাফিয়া সিন্ডিকেট এই সুযোগে চালের দাম বাড়াবে, সেই দায়ও রোহিঙ্গাদের? আমরা বুঝে কথা বললে বোধ হয় ভালো হয়; কী বলেন? গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা কর্মী  ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App