×

সারাদেশ

ঠাণ্ডাজনিত অসুখ-বিসুখে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০৭ এএম

ঠাণ্ডাজনিত অসুখ-বিসুখে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু

ছবি: প্রতীকী

ঋতুর পরিক্রমায় প্রকৃতিতে চলছে শীতকাল। রাজধানীতে শীতের প্রকোপ এখন কম হলেও ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শিশু ও বয়স্কদের ওপর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, সিওপিডিজাতীয় শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। তবে শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যের সঙ্গে স্থানীয় তথ্যের গরমিল রয়েছে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ নভেম্বর থেকে গতকাল ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এআরআই বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ আর ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের বাকি ২১ জন এআরআইতে মারা গেছে। এদিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের তথ্য বলছে, নভেম্বরে শেষের দিক থেকে চলতি ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালেই ৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে শীতকালীন রোগে মৃত্যু হয়েছে ২ শিশুর। তথ্য উপাত্ত বলছে, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, সিওপিডিজাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগের প্রকোপ শীতকালে বেড়ে যায়। যাদের আগে থেকে ঠাণ্ডার সমস্যা আছে তাদের নিউমোনিয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। এটি যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে কম বয়স এবং বেশি বয়সে এ রোগে আক্রান্তের আশঙ্কা বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর দেশে ২৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের পাশাপাশি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদেরও নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ হিসেবে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আগে থেকেই নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণ ও অনিরাপদ পানি পানের ফলেও শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ নভেম্বর থেকে গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৬২০ জন। মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯১০ জন ও মৃত্যু হয়েছে একজনের। অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে ১১ হাজার ২২০ জন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত ২২ জনের সবাই চট্টগ্রাম বিভাগের। এর মধ্যে কক্সবাজারে ১৭ জন, একজন রাঙ্গামাটি এবং ৩ জন খাগড়াছড়ির। আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যে একজনের মৃত্যু হয়েছে তিনি কক্সবাজার এলাকার। এরপরই রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগে রোগী ছিল ৫ হাজার ৮১১ জন। খুলনায় ৩ হাজার ২৮২ জন, বরিশালে ১ হাজার ৪৯৫ জন, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৩৫০ জন, রাজশাহীতে ৭৮২ জন, সিলেটে ৫৫৭ জন আর রংপুর বিভাগে ১২৩ জন। এদিকে বিভাগ অনুযায়ী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ঢাকায় ২ লাখ ২০ হাজার ৫৭৮ জন, ময়মনসিংহে ৬ হাজার ২৯৪ জন, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ২২ জন, রাজশাহীতে ৫ হাজার ২৭৯ জন, রংপুরে ৩ হাজার ৮০৭ জন, খুলনায় ৮ হাজার ৪৫৪ জন, বরিশাল ৪ হাজার ৯৯১ জন এবং সিলেটে ১ হাজার ৪৭৬ জন। ঢামেক হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ে। স¤প্রতি ঢামেক হাসপাতালে দৈনিক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৮ থেকে ১০ শিশু ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু শিশুর অবস্থা খুবই গুরুতর। ইউজিসি অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, শীতের সময় বরাবরই ঠাণ্ডাজনিত জ্বর, সর্দি, কাশি, হাঁপানি, গিঁটে বাতের ব্যথার মতো কিছু রোগ দেখা দেয়। প্রচলিত কিছু ওষুধেই আবার তা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এসব রোগের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। অনেক উপসর্গেই পরিবর্তন আসছে। আবার আগে যেসব ওষুধের সহজে কাজ হতো এখন সেগুলোতে কাজ হয় না। ময়মনসিংহ প্রতিনিধি রুহুল আমিন খান জানান, মমেক হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত নভেম্বরে শেষের দিকে এবং চলতি ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত ১১০ বেডের বিপরীতে ৬১৩ জন শিশু, নবজাতক ওয়ার্ডে ৫০টি বেডের বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিল ২০৪ জন। শিশু ওয়ার্ডে ৬০ বেডের বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিল ৪০৯ জন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে নবজাতক ওয়ার্ডে ভর্তি ১ হাজার ৩৫৩ জনের মধ্যে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ৩০ ও ৩১ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়া ২ হাজার ৮৭৭ শিশুর মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। মমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. গোলাম কিবরিয়া বলেন, বিভিন্ন উপজেলা থেকে নবজাতক ও শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রোগীর চাপ বেশি থাকলেও চিকিৎসকরা খুবই আন্তরিক। রংপুর প্রতিনিধি হাসান গোর্কি জানান, রংপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোতে শীত জেঁকে বসতে শুরু করেছে। শিশু ও বয়স্করা শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্তও হচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর-সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। রমেক হাসপাতালে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৭১ জন ভর্তি হয়েছেন। গত দুদিনে ভর্তি হয়েছেন ১২৩ জন। যাদের সবার বয়স এক মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে ২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের শিশু বিভাগের রেজিস্ট্রার শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এ এন এম তানভীর চৌধূরী জানান, এবার কোল্ড ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মাসে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে। গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের চেয়ে চলতি ডিসেম্বরে রোগী ভর্তির হার বেশি। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ও নবজাতক ওয়ার্ডে গত পাঁচ দিনে ঠাণ্ডাজনিত রোগে ৪০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার বিকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী। পঞ্চগড় প্রতিনিধি আবু সাহেল মো. রায়হান জানান, শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সেবা নিতে আসছেন রোগীরা। এদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধই বেশি। সবচেয়ে বেশি রোগী পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ১ হাজারেরও বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। গত নভেম্বর মাসে গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০০ থেকে ২২০ জন শিশু, ১৭০ থেকে ১৯০ জন পুরুষ এবং ১৮০ থেকে ২০০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। ডিসেম্বরেও একই অবস্থা দেখা গেছে হাসপাতালটিতে। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ১৬টি শিশুশয্যার বিপরীতে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর শিশু রোগী বেশি। বেশির ভাগ শিশু রোগী জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত নানা রোগ নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। শিশুদের গরম কাপড় পরানোসহ ঠাণ্ডা না লাগানো, বাসি খাবার না খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App