×

জাতীয়

পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ জেনারেল মানেকশর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:১১ এএম

পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ জেনারেল মানেকশর

ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর। দুপুরে গোপনে গানবোট, লঞ্চ, স্টিমারে বরিশাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা। হানাদার বাহিনীর গোপনে পালানোর খবরটি জানাজানি হয়ে গেলে দুপুর ২টায় বরিশালে হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। আর বিকাল ৩টায় সুলতান মাস্টার ও আবদুল মান্নানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বরিশালে প্রবেশ করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় বরিশালের আকাশ-বাতাস। দিকে দিকে তখন উড়ছে লাল-সবুজের বিজয় পতাকা। শুধু দক্ষিণাঞ্চলের বরিশালই নয়, ডিসেম্বরের এই দিনে মুক্ত হয় পিরোজপুর, মধ্য পূর্বাঞ্চলের শহর কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া। জয় বাংলা স্লোগান আর লাল-সবুজের নিশানে শত্রুমুক্ত অঞ্চলগুলোয় তখন বিজয় উল্লাস।

দৈনিক আনন্দবাজারের (৯ ডিসেম্বর ১৯৭১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনাবহুল ৮ ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আজ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে শত্রুর ওপর শেষ আঘাত হানতে হবে এবং বাংলাদেশের মাটিতে তাদের কবর রচনা করতে হবে। দেশ যখন আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে, তখন সে আহ্বানে যেন আমরা সাড়া দিতে পারি। আগামীকাল যেন কখনো আমাদের অপবাদ দিতে না পারে যে, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করিনি। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তাজউদ্দীন আহমদ।

বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব তুলেছে, তাতে বোঝাই গেছে তারা সংঘর্ষের মূলে পৌঁছায়নি। এর মূল কারণ আমেরিকা চোখ বন্ধ করে আছে। এটা তাদের মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। চীন পাকিস্তানকে সবসময় বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে উসকানি দিয়েছে।

পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ মানেকশর : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র পঞ্চম, ষষ্ঠ, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড এবং আনন্দবাজারের (৯ ডিসেম্বর ১৯৭১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এদিন বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ।

আকাশবাণী রেডিও থেকে উর্দু, হিন্দি ও পশতু ভাষায় প্রচারিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সময় দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাকিস্তানি সেনাদের উচিত ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করা। বর্তমানে পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল ও নানা বন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে এসে সমবেত হচ্ছে। কিন্তু এখানেও তোমরা আশ্রয় নিতে পারবে না। শিগগির এখান থেকেও উচ্ছেদ হবে। ইতোমধ্যে তোমাদের বিমানবাহিনী অকেজো, তাদের থেকে তোমাদের সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই। বহির্বিশ্বের কোনো দেশ থেকেও তোমরা সাহায্য পাবে না। আমরা তোমাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছি। সমুদ্রপথেও কেউ তোমাদের কাছে রসদ সাহায্য পাঠাতে পারবে না। তোমাদের হাতে এখন প্রাণ বাঁচানোর একটিই সুযোগ। সেটি হলো আত্মসমর্পণ। আর যদি আত্মসমর্পণ না করো, তবে তোমাদের ভাগ্যে রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু। যদি তোমরা আত্মসমর্পণ কর, তবে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তোমাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে।

৩ দিনের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে : এদিন কলকাতায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বলেন, আগামী ৩ দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। তবে পশ্চিম রণাঙ্গনে আরো কয়েকদিন যুদ্ধ চলবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বিতাড়িত। আমি জাতিসংঘ বুঝি না। আমাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী না বলা পর্যন্ত ভারতীয় সেনারা এগিয়ে যাবে। নিক্সন কিংবা ইয়াহিয়া তাদের গতিরোধ করতে পারবে না।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া। উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া। জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগেই কাজ হবে না, যদি না পাকিস্তান সংঘাতের পথ পরিহার করে।

এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ২৪০ জন জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও বিদেশি নাগরিককে নিরাপদে স্থানান্তরের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের একটি সুরক্ষিত নিরপেক্ষ অঞ্চল চেয়ে অনুরোধ জানান জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন এবং পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহীকে পৃথকভাবে ডেকে অনুরোধ করেন তিনি।

এদিন পাকিস্তানের মনোনীত উপপ্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলাফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে পেশোয়ার থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন। প্রতিনিধি দলে পিপিপি ও প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের নেতৃত্বে ৭ দলের সমন্বয়ে গঠিত কোয়ালিশন পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা ছিলেন।

আর পাকিস্তানের নাগরিকদের যুদ্ধ তহবিল খোলার আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, জনগণকে অর্থের অপচয় বন্ধ ও উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশের এই সর্বাত্মক যুদ্ধের সময় সবাইকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। যে নাগরিকদের মাসিক আয় ২ হাজার টাকার বেশি, তাদের শতকরা ১০ টাকা এবং যাদের আয় তার থেকে কম, তাদের শতকরা ৫টাকা হারে প্রতিরক্ষা তহবিলে দিতে হবে।

মুক্তাঞ্চলে লাল-সবুজের পতাকা : এদিন বিকালে শত্রুমুক্ত কুমিল্লার টাউন হলে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এডভোকেট আহমদ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীরা জেনারেল অরোরাকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান। জামালপুরে অবস্থানরত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অনুরোধে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর বড় একটি দল টাঙ্গাইলে চূড়ান্ত হানাদারমুক্ত অভিযান না চালিয়েই জামালপুরের দিকে যাত্রা করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App