×

মুক্তচিন্তা

গণসমাবেশ গণসমর্থন আদায়ে কতটা ভূমিকা রাখবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৮ এএম

গণসমাবেশ গণসমর্থন আদায়ে কতটা ভূমিকা রাখবে

বিশ্ব রাজনীতিতে এখন বৈশ্বিক মহামন্দার বাতাস বইছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি সংকট, ডলার সংকট, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা, খাদ্য পণ্য সরবরাহে বাধা, অর্থনৈতিক অবরোধ-পাল্টা অবরোধ, দেশে দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বাভাবিক চেহারাকে পাল্টে দিয়েছে। পূর্ব থেকে পশ্চিম উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই মূল্যস্ফীতির একটা উত্তাপ সবাইকে তাড়া করছে। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গত ৪০ বছরের ইতিহাসে এমন মূল্যস্ফীতির ভয়াবহতা লক্ষ্য করেনি সেখানকার জনগণ, একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই নিউজিল্যান্ড বা তুরস্কের অর্থনীতিতেও। করোনা মহামারির পর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বময় সংকট বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশকেই এ অভিঘাত সামলাতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়, খাদ্য কিংবা জ্বালানি আমদানিনির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশকেও পড়তে হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই সংকট মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একদিকে জ্বালানির অভাব অন্যদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি প্রক্রিয়াকে মন্থর করেছে, ফলে স্বাভাবিক পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, যাতে দ্রব্যের সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে ও দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও আমাদের কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা সবসময়ই কী করে দাম বাড়ানো যায় তার একটা বাঁকা পথ খুঁজতে থাকেন। ফলে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে তারাও পণ্যের দাম বৃৃদ্ধি করছেন হারাম-হালাল বাছ-বিচার না করে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়েছে যাকে সুযোগ হিসেবে লুফে নেয় দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। যদিও তারা বিগত সময়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণদাবি আদায়ে নানান সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করার সুযোগ হাতছাড়া করেছেন বলে সবার অভিমত। তবে রাজনীতি সর্বদাই জনকল্যাণকামী হওয়া উচিত। যদিও বিএনপি ক্ষমতার রাজনীতি থেকে অনেক দিন বাইরে আছে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত বা নির্বাচন প্রতিহত করার মতো কিছু পদক্ষেপের জন্য, যা এখনো তাদের নেতাকর্মীদের মুখে শোনা যাচ্ছে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে, রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের শক্তি সামর্থ্য জানান দিতে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর নানা কৌশল গ্রহণ করছে। অতীত অভিজ্ঞতা ও বৈশ্বিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো এরই মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক ও সংলাপের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করে। বিএনপি ও সমমনা জোট সরকারের পদত্যাগের জন্য আন্দোলনের নতুন কৌশল হিসেবে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। গত ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে শুরু করা এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ খালেদা জিয়ার মুক্তি, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা সবার সামনে নিয়ে আসে। ১০ ডিসেম্বর তাদের ঢাকার গণসামবেশ, যা নিয়ে সব মহলে নানা আলোচনা ও কৌতূহল শুরু হয়েছে। আবার একইভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সারাদেশে দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে নিজেদের কমিটি গঠন, ত্রিবার্ষিক সম্মেলন, জেলা-উপজেলা কমিটি ঘোষণা, দল পুনর্গঠন এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও বিগত দিনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে সবার সামনে তুলে ধরতে জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় জনসভা কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে। এরই মধ্যে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে দলীয় সভা সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি। একদিকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে মাঠের রাজনীতিতে নিজেদের শক্তির জানান দেয়া, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে ভোটের রাজনীতিতে নিজের অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেয়াসহ নতুন ভোটার বা আমজনতাকে দলে টানার অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে। রাজনীতির বোদ্ধারা কেউ কেউ ব্যাখ্যা করছেন সমাবেশের উপস্থিতি ও লোক সমাগম ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জনসমর্থন বা জনপ্রিয়তার নির্ধারক হিসেবে হয়তো প্রভাব ফেলবে। তবে সমাবেশের উপস্থিতি রাজনৈতিক সমর্থনের নির্দেশক হতে পারে না। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই টকশো বা গণমাধ্যমে বলে যাচ্ছেন ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ও জনসভাগুলোতে মানুষ অভূতপূর্বভাবে সাড়া দিয়েছিল এবং জনতার ঢল নেমেছিল; কিন্তু সে নির্বাচনে বিএনপি বিজয় লাভ করে। অথচ তখন তাদের এককভাবে ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতা ছিল না। এখনো অনেকে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির জনসমাবেশের দৈর্ঘ্য প্রস্থ হিসাব করে ক্ষেত্রফল বের করতে চেষ্টা করছেন; কিন্তু বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে। অর্থাৎ সমাবেশের উপস্থিতি যে রাজনৈতিক সমর্থনের নির্দেশক নয় তা-ই ইঙ্গিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার কী অবদান তাও কিন্তু মানুষ হিসাব করবে এবং করছেও। আওয়ামী লীগ তাদের জনসভায় উন্নয়নের নানা দিক তুলে ধরছে যেমন- পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল কিংবা আরো অন্যান্য দিক। তবে বিএনপি বলছে এ সরকার যত সময় এবং যত অর্থ মেগা প্রজেক্টে ব্যয় করেছে তা যদি সঠিকভাবে ব্যয় হতো তবে তা দিয়ে বাংলাদেশকে আরো উন্নত করা যেত, তারা অভিযোগ করছে সরকারের টাকা যথাযথভাবে ব্যয় হয়নি বরং নেতাদের কেউ কেউ পকেট ভারি করেছেন। বিএনপি বলছে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তারা গণঅভ্যুত্থান করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে। পরিসংখ্যান বা ইতিহাসের পর্যালোচনা বলছে ভিন্ন কথা, ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতা লাভ করে তার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনটি গণঅভ্যুত্থান দেখা যায়, যেখানে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তা হচ্ছে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও আইয়ুব খানের পতন, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং এরশাদ সরকারের পতন এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন ও খালেদা জিয়ার পতন। এ দিক বিবেচনায় বিএনপির গণঅভ্যুত্থানের দাবি গণরূপ পাবে কি না তা আপেক্ষিক বলা চলে। কারণ গণআন্দোলনের ইতিহাসে তাদের নেতৃত্ব অতীতে তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে তারা যদি বর্তমান সরকারের চেয়ে বেশি কিছু করে দেখানোর বা বাংলাদেশকে দেয়ার মতো নতুন কোনো নজির স্থাপন করতে পারবেন বলে জনগণকে আশ্বস্ত করে, তবে হয়তো জনগণ তাদের গ্রহণ করতেও পারে অথবা রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা জনগণকে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে। তবে গণসমাবেশগুলো গণসমর্থন বা রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা-ই এখন দেখার বিষয়।

তানজিব রহমান : লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App