×

জাতীয়

রাজপথ বনাম উদ্যান ছাড় দিচ্ছে না কেউই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৫০ এএম

রাজপথ বনাম উদ্যান ছাড় দিচ্ছে না কেউই

ছবি: সংগৃহীত

১০ ডিসেম্বর ঢাকাকে সমাবেশের নগরীতে পরিণত করতে চায় বিএনপি

হাতে সময় মোটে ৩ দিন। বাকি আনুষঙ্গিক অনেক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। অথচ এখনো ঠিক হয়নি ভেন্যু। নয়াপল্টন, আরামবাগ, নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান? কোথায় হচ্ছে বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশ? এমন প্রশ্নে দলটির নীতিনির্ধারকদের সাফ জবাব- ‘নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে’। যদিও নেতারা স্পষ্ট করেছেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ কিংবা সমাবেশস্থল নিয়ে কোনো সংঘাত চান না তারা। তবে বাধা এলে প্রতিরোধের ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। দলটির নেতারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা ও রাজধানীবাসীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেই বিকল্প জায়গার কথা এসেছে আলোচনায়। তবে শেষ পর্যন্ত যে ভেন্যুতেই হোক না কেন, ওইদিন পুরো ঢাকা সমাবেশের নগরীতে পরিণত হবে।

১০ ডিসেম্বর রাজপথে শক্তির ‘খেলা’য় মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে সব উত্তেজনা এখন সমাবেশের ভেন্যুকে ঘিরে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে, সংসদ ভবনের সামনের মানিক মিয়া এভিনিউ ও আরামবাগে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল বিএনপি। পুলিশ অনুমতি দিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু বিএনপি সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ না করার সিদ্ধান্তে অনড়। এ কারণে বাকি দুটি ভেন্যুর বিষয়ে আলোচনা করতে বিএনপির নেতারা কয়েক দফা ডিএমপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। লাভ হয়নি। ডিএমপির সাফ জবাব, খোলা রাস্তায় সমাবেশের অনুমতি পাবে না বিএনপি।

ডিএমপির মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে তারা দেখা করে বিকল্প ভেন্যুর প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। তবে ডিএমপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিকল্প ভেন্যুর চিন্তা করা হয়নি। বিএনপিকে রাস্তার ওপরে সমাবেশের অনুমতি ডিএমপি দেবে না।

অন্যদিকে বিএনপির নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার অনুমতি না দিলেও নয়াপল্টনেই তারা সমাবেশ করবেন। পক্ষান্তরে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা সাবধান-হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে সংঘাতের।

সমাবেশ করতে বিএনপি কেন নয়াপল্টনে অনড়? পুলিশই বা কেন সোহরাওয়ার্দীতে আগ্রহী? এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। বিশ্লেষকদের মতে, কৌশলগত সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেই ভেন্যু পছন্দ করেছে বিএনপি। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরে পাল্টা কৌশল এঁটেছে ডিএমপি।

সূত্র জানায়, সরকারের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপিকে ঢাকার মধ্যে সমাবেশ করতে দেবে না। সরকারি দলের নেতারা বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীর মতো করেই সমাবেশ টঙ্গী বা পূর্বাচলে নেয়ার কথা বলছিল। ঢাকার মহাসমাবেশে ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ লোকের জমায়েতের কথা বলছিলেন বিএনপির নেতারা। সরকারি দলের নেতাদের যুক্তি হলো, ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করার মতো ভেন্যু ঢাকার ভেতরে নেই। পরে সোহরাওয়ার্দীতে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়ার সুবিধাটা হলো, বিএনপিকে তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের করে আনা। তার চেয়ে বড় কথা হলো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশপথ মাত্র দুটি। ফলে বিএনপির সমাবেশ মনিটর করা এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের জন্য সহজ হবে।

ঢাকার সমাবেশ ঘিরে প্রথম থেকেই বিএনপি নেতাদের হুমকি-ধামকি ‘সিরিয়াসলি’ নিয়েছে সরকার। হেফাজতের মতো বিএনপিও সমাবেশের নামে রাজপথে অবস্থান নিয়ে সরকার পতনের ডাক দিতে পারে। এ কারণে আগে থেকেই সরকার সতর্ক। সমাবেশের অনুমতি দেয়ার আগে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন দেখার কথা বলেছে পুলিশ। আওয়ামী লীগ সেদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পাহারা বসানোর কথা বলেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা নৈরাজ্য করার চেষ্টা করলে শক্ত হাতে প্রতিহতের হুঙ্কারও দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন নেতারা।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না চাইলে পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার মাঠ, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠ বা কামরাঙ্গীরচরের মাঠে যেতে পারে। বিএনপি একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় আছে। এমন শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।

কিন্তু বিএনপি এখনো নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দলটির শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য- ‘পার্টি অফিসের সামনেই বিএনপি সমাবেশ করে, এটা নতুন কিছু নয়। নয়াপল্টনে অনুমতি না দিয়ে সরকার কেন উপযাচক হয়ে সোহরাওয়ার্দীতে অনুমতি দিল? এখানে গভীর চক্রান্ত ও দূরভিসন্ধি থাকতে পারে। তবে সব বাধা ডিঙিয়ে নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে। রাজপথে সমাবেশ করতে বাধা দিলে সব দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। বিএনপির মহাসচিব কয়েক দফায় জানিয়েছেন, নয়াপল্টনেই তারা বছরের পর বছর সমাবেশ করছেন। এই স্থানেই খালেদা জিয়া দফায় দফায় সমাবেশ করেছেন। সে কারণে নয়াপল্টনেই অনুমতি দিতে হবে। সোহরাওয়ার্দীতেই সমাবেশ করতে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অনড় অবস্থানের পর বিএনপির সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ভোরের কাগজকে সাফ জানান- ‘ঢাকার মহাসমাবেশ পার্টি অফিসের সামনেই হবে’।

বিএনপির নেতারা বলছেন, আমরা রাজপথের লোক। নয়াপল্টন ছাড়া কোথাও সমাবেশ করব না। কারণ এই জায়গাটি দলের কমফোর্টের ব্যাপার। এছাড়া নয়াপল্টনে সমাবেশের ব্যাপারে বিএনপির অনড় থাকার অনেকগুলো কারণ আছে। চাইলে সমাবেশটি পশ্চিমে কাকরাইল থেকে পূর্বে আরামবাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া যায়। এছাড়া নয়াপল্টনের আশপাশে ২০-২৫টি আসা-যাওয়ার পথ আছে। তাই মানুষ সহজেই আসতে পারবে। আর কোনো সংঘর্ষ হলে সহজে পালাতে পারবে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলেও অনেকক্ষণ তা চালিয়ে নেয়াসহ বেশি বিপদ হলে নেতাকর্মীরা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও আশ্রয় নিতে পারবে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত এসেছেন, পল্টন পর্যন্তও আসবেন। নয়াপল্টনে সমাবেশ হবেই।

সূত্র জানায়, সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে ৫ ডিসেম্বর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপস্থিতিতে জোর আলোচনা করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। নেতাদের মতে, সরকার অজানা ভয় ও আতঙ্ক থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করাতে চাইছে। এর পেছনে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিও রয়েছে। বিএনপিকে দেয়ালবেষ্টিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবদ্ধ রেখে নিজেদের নিরাপদ রাখা, একই সঙ্গে নয়াপল্টন এলাকায় বড় গণজমায়েতের যে রাজনৈতিক প্রভাব, সেখান থেকে বঞ্চিত করার কৌশল রয়েছে আওয়ামী লীগের। ফলে কোনোমতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ নয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার কেন বাধার সৃষ্টি করছে এটাই বড় প্রশ্ন। স্খানটি কোথায় হবে, না হবে, সেটা প্রশ্ন নয়। এটা বিরোধী দলের সমাবেশ। তারা যেখানে সুবিধা মনে করবে সেখানে করবে। শুধু আইনশৃঙ্খলার পরিপন্থি যেন না হয় সেটা জরুরি। এটা নিয়ে যুক্তিতর্ক, বিকল্প প্রস্তাবের কোনো মানে নেই। এ নিয়ে সরকারের বাড়াবাড়ি না করাই উত্তম হবে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে পাইনি। কেন সরকার আগ বাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দীতে অনুমতি দিল? এর পেছনে সরকারের দুরভিসন্ধি রয়েছে।

সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা হবে জানিয়ে মির্জা আব্বাস বলেন, সরকার যদি কোনো ঝামেলা না করে, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ঝামেলার সম্ভাবনা নেই। সরকার অনেকের মাধ্যমে আমাদের জিজ্ঞেস করছে, আপনারা কি বসে যাবেন? আমরা বসে যাব, আমরা কখনো বলি নাই। আমরা কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য এখন সমাবেশ করছি না। তবে সরকার পতনের লক্ষ্যে আমরা সমাবেশ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দেব।

গতকাল মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে কমিটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী বলেন, আমরা সাফ জানিয়ে দিয়েছি; সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অনিরাপদ। আমরা সেখানে কোনো সমাবেশ করব না। আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলেছি, অতীতে বিএনপি অফিসের সামনে অনেক মহাসমাবেশ হয়েছে। অফিসের সামনে আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App