×

মুক্তচিন্তা

ব্রিটেনে স্টুডেন্ট ভিসা এবং অভিবাসন সমস্যা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১১ এএম

ব্রিটেন ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পরও হিমশিম খাচ্ছে অবৈধ অভিবাসী বা বহির্গমন ঠেকানো। অথচ ইইউ থেকে বেরোনোর এক অন্যতম প্রধান কারণ হলো বহির্গমন ঠেকানো। যেটা ছিল তাদের জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুও। কিন্তু কার্যত এটা মোকাবিলা করা রীতিমতো একটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত শরণার্থী হিসেবে যারা আসছে, তাদের দায়ভার নিতে হয় দেশটার। দায়ভার নেয়া মানে তাদের থাকা-খাওয়াটা এমনকি আইন-আদালত সবকিছুর জন্যই বিশাল অঙ্কের অর্থ ঢালতে হয় সরকারের। দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদিনেই হাজারের কাছাকাছি শরণার্থী শুধু ইংলিশ চ্যানেল দিয়েই পেরিয়ে যায়। গত কয়েক বছরে ফ্রান্স থেকে ছোট নৌকায় করে যুক্তরাজ্যে পৌঁছানো মানুষের সংখ্যা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এত কড়াকড়ি থাকা সত্ত্বেও দেশটির এমওডি ফিগার অনুযায়ী (মিনিস্টি অব ডিফেন্স) গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ৪১ হাজারেরও বেশি মানুষ ব্রিটেনে প্রবেশ করেছে কাগজপত্রে অনুমোদিত শরণার্থী হিসেবে। এর বাইরে তো অর্থাৎ উড়োজাহাজে এসে এখানে শরণার্থী হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে সমালোচনার মাঝে আছে সরকার। সরকারও কঠোর পথ অবলম্বন করতে চাচ্ছে। বরিস জনসনের সরকার যা শুরু করেছিল, সে পথেই হয়তো আগাবেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেবারম্যানও, সে পথে আগানোর জোর চেষ্টাও চালাচ্ছেন। সে সময়কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটল চেয়েছিলেন যারা শরণার্থী হয়ে আসবেন, তাদের তারা আফ্রিকার রোয়ান্ডার বন্দিশালায় পাঠিয়ে দেবে। শত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সত্ত্বেও বরিস জনসনের সরকার তা করতে ‘সফলতা’র মুখ যেদিন দেখছিলেন, সেদিন আদালতের এক সিদ্ধান্তে তা আটকে যায়। কিন্তু ঋষি সুনাকের সরকারও সে পথ থেকে সরে আসেননি। বরং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটা বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন নিয়েই কাজ করছেন। উল্লেখ্য, রোয়ান্ডা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবেই সরকারের পক্ষ থেকে ১২০ মিলিয়ন পাউন্ডের অর্থায়ন করা হয়েছে। শরণার্থীদের প্রতি কিছু উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে ইদানীং। সঙ্গে আগের মতো আর সার্ভিস দেয়া (ব্যবহার) হচ্ছে না। বিভিন্নভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছেন শরণার্থীরা। শরণার্থীদের স্রোত কমাতে কিংবা নিরুৎসাহিত করতে এটা করা হচ্ছে কিনা তা যদিও উঠে আসছে না, তবে আগের চেয়ে শরণার্থীরা অবহেলার শিকার হচ্ছেন, তা বিভিন্নভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে। একদম নিম্নমানের আবাসন ব্যবস্থায় শরণার্থীরা দিন কাটাচ্ছেন বলে বিভিন্নভাবে খবর আসছে। খাবার এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আছেন তারা। গত কয়েকদিন আগে গণমাধ্যম ফলাও করেছে এক পাকিস্তানি শরণার্থীর অনশন ধর্মঘটের খবর। এর আগে ব্রিটেনের অন্তত ৪০টি সংগঠন শরণার্থীদের সঙ্গে এ রকম আচরণের তীব্র নিন্দা করে এর তদন্ত দাবি করেছে। এ রকম যখন হযবরল অবস্থা চলছে ব্রিটেনের অবৈধ বহির্গমন ঠেকানো, তখন কিন্তু ব্রিটেনে বৈধভাবে ছাত্রছাত্রী আসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছর দুয়েক থেকে। ব্রিটেনের নির্ধারিত এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল দ্বারা অনুমোদিত একটা কোর্স সম্পন্ন করে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আসছেন ব্রিটেনে। যুক্তরাজ্য সরকার এ রকম ঢালাও সুযোগ দিয়ে থাকে কয়েক বছর পরপর। এতে করে যুক্তরাজ্য বিভিন্নভাবেই লাভবান হয়। যেমন যারা আসে, তারা শরণার্থীদের মতো বোঝা হয়ে উঠে না তাদের অর্থনীতিতে। বরং এখানে আসতে একটা বড় অঙ্কের ফিস পরিশোধ করতে হয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। অনেক শিক্ষার্থীই সঙ্গে করে নিয়ে আসে তার পার্টনার কিংবা ভালোবাসার মানুষটিকেও। এবং এরা এসে বিভিন্ন পেশায় কাজে লেগে যায়। তাছাড়া শিক্ষার্থীদেরও কাজ করার একটা সীমাবদ্ধ সময় থাকে। সুতরাং দুজনের কাজের সিংহভাগই ব্যয় হয় ব্রিটেনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। অন্যদিকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র আছে, যেগুলোতে ব্রিটেনের তারুণ্য কাজ করতে চায় না, সেসব পদও পূর্ণতা পায়। আবার একসময় এদের অধিকাংশই ব্রিটেন থেকে চলে যায় আইনগত কারণেই। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু ব্যবসাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ব্রিটেনের বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বহুজাতির বিত্তশালী মানুষের মেধাবী সন্তানরা এখানকার খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী হিসেবে আসে। এশিয়ার দেশগুলো বিশেষত চীনের ছাত্রছাত্রীদের আধিক্য দেখলে যুক্তরাজ্য নামক দেশটার শিক্ষাব্যবস্থা চীনের অর্থনীতি-সামাজ কিংবা রাজনীতি যে কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমি যদি ম্যানচেস্টারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা বলি, দেখা যাবে ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যায়গুলোর শিক্ষার্থী এরা এবং এই শহরের অভিজাত ছাত্রাবাসগুলোর অধিকাংশই দখল করে আছে চীনের ছাত্রছাত্রী। এরা কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালে এখানে, এমনকি এদের অধিকাংশই ছাত্রাবস্থায় এ দেশে খণ্ডকালীন কোনো কাজও করে না, শিক্ষা শেষে তারা দেশে চলে যায়। অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রয়োজনে এখান থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করা বিভিন্ন দেশের মেধাবীদের আকর্ষণীয় কিংবা লোভনীয় অফার দিয়ে এদেশের বিভিন্ন সেক্টরে রেখে দেয়। ব্রিটেনের মূলধারার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ আছে, যেগুলোতে বিভিন্নভাবে ঝরে যাওয়া এমনকি বয়স্ক মানুষও শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং এদেরও টিউশন ফিস সরকারকেই বহন করতে হয় এবং এই শিক্ষার্থীরা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নিয়ে থাকে। এই সুবিধাগুলো দিতেও সরকার এই বিদেশি শিক্ষার্থীদের অর্থায়নকে কাজে লাগায়। এর বাইরেও আছে কিছু কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো র‌্যাঙ্কি বিবেচনায় নিম্নমানের, সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে শিক্ষা বিভাগ কিংবা সরকার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন বিদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ দিচ্ছে ব্রিটেনে আসার। যেহেতু ভর্তির জন্য একটা নির্ধারিত ফিস আছে জাতীয়ভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই, সেহেতু এই ফিস দিয়েই আনুষঙ্গিক সব হিসাব চুকিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের এখানে আসতে হচ্ছে। ব্রিটেনের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা এই দেশগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেছে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই সে কারণে ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থাটা এই দেশের অর্থ আয়েরও একটা উৎসও বটে। কিন্তু দুই বছর ধরে এদেশে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা আসায় কিছুটা সমালোচনায় পড়েছে সরকার। যা ইতোমধ্যে পার্লামেন্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এক আলোচনায় বলেছেন তিনি কিংবা তার সরকার এ নিয়ে একটা পরিকল্পনায় যাচ্ছেন, এতে বিশেষত নিম্নমানের ডিগ্রি কোর্সগুলোতে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা আনবেন। এ পরিকল্পনায় তারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক সংখ্যা হ্রাস করার ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিশেষত ঢালাওভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের পার্টনার বা প্রিয়জনকে নিয়ে আসার ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন, যদিও এখনো কঠোর কোনো সিদ্ধান্তে যায়নি সরকার। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগমনে বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। ডাউনিং স্ট্রিট ইঙ্গিত দিয়েছে যে, সামগ্রিক সংখ্যা কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের প্রিয়জনদের জন্য বাধা সৃষ্টি করা এবং শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি সীমাবদ্ধ করা এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। কারণ গত ২০২১-এর জুন থেকে ২০২২-এর জুন পর্যন্ত বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অভিবাসীদের আগমন ৫ লাখের অধিক হয়ে গেছে এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্রিটেনে আসার জন্য শিক্ষার্থী ভিসা প্রাপ্তির প্রত্যাশা করছেন, তাদের আইএলটিসের পাশাপাশি ভালো রেজাল্ট অবশ্যই প্রয়োজন হতে পারে আগামীতে। যেহেতু নিম্নমানের ডিগ্রিগুলোতে সরকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, সেহেতু যারা ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পছন্দ-অপছন্দের দোলায় দোলছেন কিংবা এখনো সময় নিচ্ছেন, তারা আশাহত হতে পারেন, ব্রিটেন সরকারের আগামী সিদ্ধান্তে। কারণ ব্রিটেন এখন অভিবাসন ইস্যুটা রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। সরকার গভীরভাবে এবং গুরুত্বসহকারে এটাকে গুরুত্ব দেবেই। ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App