×

মুক্তচিন্তা

বিএনপি কি বদলাবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১১ এএম

আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করার বিষয়টিকেই বিএনপি তাদের মর্যাদার লড়াই হিসেবে নিয়েছে। ১০ ডিসেম্বর বিএনপি যদি তাদের ইচ্ছামতো নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে পারে, তাহলে কি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে? যদি তা না হয়, তাহলে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে বিএনপির এত আগ্রহ বা উৎসাহ কেন? বিএনপি কি বিশেষ কোনো শক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ? বিএনপি ক্ষমতাসীন দল নয়। তাকে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই সমাবেশ করতে হবে। তারা সমাবেশের জন্য অনুমতি পাওয়া স্থানের বাইরে অন্য কোথাও সমাবেশ করলে সেটা অন্যায় হবে। বিএনপি একটি বড় দল বলে আইন মেনে চলবে না, তা তো হতে পারে না! এই সরকারের ওপর বিএনপির যত রাগ-গোস্বাই থাক না কেন, আইন মেনে না চললে আইন তার ক্ষমতা দেখাবেই। বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগ বা ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো দরদ বা অনুকম্পা নেই। রাজনীতিতে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন বলে একটি কথা আছে। দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্বেষী রাজনীতির চর্চা অব্যাহত থাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পারস্পরিক অবস্থাও এখন পয়েন্ট অব নো রিটার্নে পৌঁছে গেছে। আওয়ামী লীগকে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় বিএনপি। আবার বিএনপির জন্যও আওয়ামী লীগের ছাড় দেয়ার মানসিকতার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। চট্টগ্রামের বিশাল সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেছেন, ‘একটি প্রতিশ্রæতি চাই যে অতীতের মতো আগামী নির্বাচনেও নৌকায় ভোট দেবেন ও আমাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন’। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী, খুনি ও জাতির পিতার খুনিদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দল জামায়াত-বিএনপি বাংলাদেশের মাটিতে যেন আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। এই বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা হলো এটা বোঝানোর জন্য যে, আগামী নির্বাচনেও শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বিএনপি-জামায়াতের পরাজয় প্রত্যাশা করেন। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বুঝতে হবে আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে ছাড় দেয়া না-দেয়ার বিষয়টি। এই পটভূমি মাথায় রেখে একটু বিএনপির রাজনীতির অতীতটা দেখে আসা যেতে পারে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি গত ১ সেপ্টেম্বর ৪৩ বছর পূর্ণ করেছে। ৪৪ বছরে পা দিয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণত শতায়ু কামনা করা হয়। কারণ সাধারণত খুব কম সংখ্যক মানুষই শত বছরের বেশি বাঁচে। কিন্তু রাজনৈতিক দল শত বছরের বেশি বাঁচতে পারে, বাঁচে সে তথ্য আমাদের জানা। কমিউনিস্ট পার্টির বয়স শত বছরের বেশি। ভারতের কংগ্রেসও শত বছর অতিক্রম করছে। মুসলিম লীগও তাই। তবে এই দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছে মুসলিম লীগ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবং মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে না পারার কারণেই সাধারণত রাজনৈতিক দলগলো প্রাসঙ্গিকতা হারায়, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আমাদের দশের অন্যতম দুটি জনপ্রিয় দল। আওয়ামী লীগ বয়সে বিএনপির চেয়ে প্রবীণ। বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় নবীন। তবে ৪৩ বছর একটি রাজনৈতিক দলের জন্য একেবারে কম সময় নয়। বিএনপির জন্ম প্রক্রিয়াটা একটু ভিন্ন। রাজনৈতিক দল সাধারণত গঠন করা দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্য সামনে নিয়ে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন দলের জন্ম হয়। কিন্তু বিএনপির জন্ম হয়েছে ক্ষমতায় থেকে এবং ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলটির জন্মবার্তা ঘোষণা করা হয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ইচ্ছায়, উদ্যোগে ও প্রয়োজনে এই দল গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ওই বছরের ৭ নভেম্বর দেশের এক বিশেষ পরিস্থিতিতে সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান উর্দি পরেই রাজনীতির নিয়ন্তা হয়ে ওঠেন। ১৯৭৭ সালে ৩০ এপ্রিল জিয়াউর রহমান তার সামরিক শাসনের গায়ে বেসামরিক আলখাল্লা চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেন। জিয়া রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করার ইচ্ছে পূরণের জন্যই প্রথমে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল বা জাগদল পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর অনেক ঘটনা। রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করার জন্য বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে জিয়া পাঁচমিশালি যে দলটি গঠন করেন, সেটি তার শাসনের ভিত্তিকে শক্ত করেছে না দুর্বল করেছে, তা ইতিহাসবিদেরা খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু আমরা বাইরে থেকে এটাই দেখেছি যে বিএনপি গঠনের ৩ বছরের মাথায় জিয়া নৃশংসভাবে নিহত হন। ঘটনাচক্রে খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে দলের নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হন। তারপর অনেক বছর চলে গেছে, ঘটনাও এক জায়গায় থেমে থাকেনি। বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়েছেন বেগম জিয়া, বিরোধী দলেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে একের পর এক রাজনৈতিক বিচ্যুতির ধারায় বিএনপি এখন পথহারা, দিশাহারা, অসার তর্জন-গর্জনের দলে পরিণত হয়েছে বিএনপি। ৪৩ বছর বয়স পার করার পরই কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠছে, বিএনপির কি আর উত্থানের সম্ভাবনা নেই? অথবা বিএনপি কি মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করবে? আমরা সবাই জানি, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালির স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিয়ে মুসলিম লীগ দ্রুতই এই ভূখণ্ডে নিজের কবর রচনা করে। তারপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। মুসলিম লীগ নামে দল বাংলাদেশে এখনো আছে কিন্তু একেবারেই নাম ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাঙালির শীর্ষ এবং খ্যাতিমান নেতারা এই দলের গৌরবের পতাকা বহন করছেন। সব থেকে বড় কথা, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই দলের নাড়িপোতা হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ এখন অবিভাজ্য নাম ও সত্তা। আওয়ামী লীগের বিকাশ ও উত্থান অনেক বন্ধুর পথ ধরেই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের নাম মুছে ফলার যে ঘৃণ্য নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল তা প্রতিহত ও বানচাল করা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন নতুন প্রাণশক্তিতে বলীয়ান এক নবউত্থিত রাজনৈতিক শক্তির নাম। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় ক্ষমতার কিছু ব্যাধিতে আওয়ামী লীগ আক্রান্ত হয়নি তা নয়। কিন্তু এই দলই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশার প্রতীক। অন্যদিকে ৪৩ পেরিয়ে বিএনপি এখন এক হতোদ্যম ন্যুব্জ রাজনৈতিক দল। বিএনপি রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে এখন যে দুঃসময় অতিক্রম করছে অতীতে এত খারাপ সময় আর আসেনি। দলের প্রধান নেত্রী দুর্নীতির মমলায় শাস্তি পেয়ে দুই বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে থেকে সরকার প্রধানের অনুকম্পায় জেলের বাইরে থেকেও রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। দ্বিতীয় প্রধান তারেক রহমান ‘পলাতক’। দণ্ডিত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রায় কী হয়, দেখার বিষয়। খালেদা জিয়া অসুস্থ, স্বাভাবিক হাঁটাচলাও করতে পারছেন না বলে জানাচ্ছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতারা। চলৎশক্তিহীন একজন নেত্রী, বহুধাবিভক্ত কোন্দলজর্জরিত একটি দলকে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে যেতে কতটুকু সক্ষম হবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে রাজনীতির নতুন প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণের জন্য আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিএনপি যদি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করতে পারে তাহলে শতবর্ষী বটবৃক্ষ হলেও হতে পারে। তবে বর্তমানে বিপর্যস্ত-পর্যুদস্ত বিএনপি। সম্প্রতি ৯টি বিভাগীয় সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ছিল কিছুটা আশা জাগানিয়া। নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। ভাবা হচ্ছে, এখন বিএনপি চাইলে সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলনে যেতে পারে! তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনসভায় জনসমাগম দেখে কোনো রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা পরিমাপ করা ঠিক নয়। জনসভায় লোক বেশি হয়ে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে, বিএনপি রাজনীতিতে ভুল করুক আর শুদ্ধ করুক, দেশে বিএনপির সমর্থক মানুষের সংখ্যা কম নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অদ্ভুত স্ববিরোধী আছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ বিভক্তি নেই। বাংলাদেশে আছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছে, যারা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমর্থক, যারা ভারতবিরোধী এবং আওয়ামী লীগবিরোধী তারাও এখানে রাজনীতিতে সক্রিয়। এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। এদের সংখ্যা না কমে বাড়ছে। এই জনগোষ্ঠী মূলত বিএনপির সমর্থক। বিএনপির পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হবে বলে যারা খোয়াব দেখেন তারা ভুলে যান দেশের রক্ষণশীল, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির সমর্থক যতদিন থাকবে বিএনপি ততদিন বেঁচে থাকার মতো জলহাওয়া পাবেই। এই শক্তির পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় বিএনপি কখনো মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করবে না বলে আমার ধারণা। তবে প্রকৃতবিরোধী দলের ভূমিকা বিএনপি আদৌ অর্জন করতে পারবে কি না এই প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেয়া যাবে না। তারপরও মানুষ খুশি হবে বিএনপি একটি দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন এগিয়ে এলে! বিএনপি রাজনীতির বড় দুর্বলতা তারা সময়ের সঙ্গে চলতে পারে না। দেশ সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি সবই সময়ের চাহিদা পূরণে করেই এগিয়ে চলে। বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App