×

জাতীয়

স্বাধীন দেশের ললাটে প্রথম স্বীকৃতির তিলক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:১০ এএম

স্বাধীন দেশের ললাটে প্রথম স্বীকৃতির তিলক

ফাইল ছবি

একাত্তরের ক্যালেন্ডারে ইতিহাস পাল্টে দেয়া দিন ৬ ডিসেম্বর। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র। ওইদিন ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের সূচনা হয়েছিল। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত-ভুটানের স্বীকৃতি মহান মুক্তিযুদ্ধকে নতুন মাত্রা দেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় তখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।

ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর বীর সৈনিকরা যেভাবে এগিয়ে এসে বাংলাদেশকে বিজয়ের দিকে অগ্রসর করেছেন তা অতুলনীয়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে তাদের ত্যাগ ও রক্তের ফলে যে বন্ধন গড়ে উঠেছে তা চিরকাল অটুট থাকবে।

এদিকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘স্বীকৃতির তিলক বাংলাদেশের ললাটে। বাংলাদেশের আজ বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সূর্যোদয়কে যাহারা অস্বীকার করে, তাহারা অন্ধ মাত্র, অস্বীকৃতির দৃষ্টিহীনতা সকালের রশ্মিজলকে মিথ্যা করিয়া দিতে পারে না।’

নতুন অধ্যায়ের সূচনা

প্রতি মুহূর্তে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির সময় ভারত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। পরদিন (৭ ডিসেম্বর, ’৭১) টাইমস অব ইন্ডিয়া ও আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারতীয় লোকসভার অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এ সময় লোকসভার সদস্যরা দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণাকে স্বাগত জানান। একই সঙ্গে লোকসভার অধিবেশনে হর্ষধ্বনির সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক ও গণহত্যা নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। আরও অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং শিগগিরই জাতিসংঘে বাংলাদেশ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে এদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক তার বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। অন্যদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ৫ ঘণ্টা পর ভারতের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান।

এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের স্বীকৃতির কারণে আমরা ভারতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করছি। ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের চরম বিদ্বেষ ও পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সনদের নীতি বিরুদ্ধ। জাতিসংঘে শিগগির পাকিস্তান এই বিষয়টি উত্থাপন করবে।’ এছাড়া ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যও বন্ধ হয়ে যায়।

‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস’ বইতে হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে থামাতে পারত। কিন্তু তারা সেটা করেনি। প্রকৃতপক্ষে মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকেছিল বলে ইন্দিরা গান্ধী স্বীকার করেন। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কারণেই ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর সাহস পেয়েছিল। এছাড়া ওইদিন মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেৎসেভের সঙ্গে বৈঠক করেন মস্কোতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ড. কে এস শেলভানকর। এ সময় দুজনের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে ভারতের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও পাক ভারত সমস্যায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের বিতর্ক নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়। ওইদিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ৮টি দেশের পক্ষে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাব ফের উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো ভেটো দেয়।

ভুটানের স্বীকৃতি

৬ ডিসেম্বর সকালে ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে তারবার্তা দেন। সেখানে রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক বলেন, বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূরভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।

প্রতিরোধ যুদ্ধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র অনুযায়ী, ৬ ডিসেম্বর প্রতিরোধ যুদ্ধে জয়ী হয়ে হানাদার মুক্ত হয় ফেনী, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App