×

জাতীয়

কোন্দলে স্থগিত চট্টগ্রাম নগর আ. লীগ সম্মেলন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০৬ এএম

কোন্দলে স্থগিত চট্টগ্রাম নগর আ. লীগ সম্মেলন

ফাইল ছবি

কেন্দ্রীয় নেতারা ক্ষুব্ধ, কমিটি স্থগিতের ইঙ্গিত

তিন তিনবার তারিখ ঘোষণা করেও স্থগিত হয়ে গেল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ওয়ার্ড-থানা সম্মেলন না হওয়া। তবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং মাঠপর্যায়ের তৃণমূলের নেতাকর্মী এই কারণকে ‘অজুহাত’ হিসেবে মনে করছেন। কেউ কেউ বলছেন, চট্টগ্রাম মহানগরের একজন প্রভাবশালী নেতার অনীহা, আবার কেউ কেউ বলছেন পরবর্তী নেতৃত্ব কে দেবেন সেই দ্ব›েদ্ব এই সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কেন্দ্রীয় নেতা ভোরের কাগজকে জানান, বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ওয়ার্ড-থানা সম্মেলন সমাপ্ত না করার কারণে ‘হাই-কমান্ড’ সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। ফলে হাই-কমান্ডের নির্দেশেই সম্মেলন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে এই কমিটি স্থগিত হয়ে যেতে পারে- এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন। এ ব্যাপারে অবশ্য নগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন দাবি করেছেন, অন্য কোনো কারণ নয়, থানা সম্মেলন সম্পন্ন না করতেই নগর সম্মেলন স্থগিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তারিখ ঘোষণা করা হবে।

কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে চট্টগ্রাম মহানগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দলীয় কোন্দল যেন আর মাথাচাড়া না দেয়, সেজন্য এই সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। বিশেষ কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নির্বাচনের আগের বছরে চট্টগ্রামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দলের কার্যক্রম যেমন হওয়া উচিত, তেমনটি হচ্ছে না দীর্ঘদিন থেকে। ফলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ‘কোন্দলবিহীন’ একটি সম্মেলন দেখতে চায় কেন্দ্রীয় কমিটি। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হাতে পাওয়ার পর নেতারা এরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা জাতীয় সম্মেলনের আগে কৌশলগত কারণে কোনো বিরোধ দেখতে চান না চট্টগ্রামে। এরপরও যদি বিরোধ না মেটে তাহলে এই কমিটি স্থগিত বা বাতিল হয়ে যেতে পারে।

এদিকে গতকাল সোমবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন

ডাকা হলেও সেখানে নগর সম্মেলনের প্রসঙ্গটি উঠে আসে। সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সম্মেলন ১৮ ডিসেম্বর হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না। এ বিষয়ে গতকাল (রবিবার) জনসভা শেষে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনারা বলেছেন, ওয়ার্ড এবং থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ করে তারপর নগর কমিটির সম্মেলন করতে।’

এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেছেন, ‘আমার ব্যর্থতা আমি সবাইকে কনভিন্স করে ওয়ার্ড-থানা সম্মেলন করতে পারিনি। এজন্য মহানগর সম্মেলন আপাতত হচ্ছে না।’ আক্ষেপের সুরে চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই নেতা ভোরের কাগজকে জানান, ‘আমরা চেয়েছিলাম ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের তৃণমূল সম্মেলন শেষ করে নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করব। কিন্তু আমরা তা পারিনি। এই ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে সারাজীবন দহন করবে।’ তবে সংবাদ সম্মেলনে আ জ ম নাছির দাবি করেন, ‘যেহেতু আমরা ওয়ার্ড ও থানাগুলোর সম্মেলন শেষ করতে পারিনি, ১৮ ডিসেম্বর নগর সম্মেলনও হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন- প্রয়োজনে জাতীয় সম্মেলনের পর নগর সম্মেলন করতে।’ কৈফিয়তের সুরে তিনি বলেন, হাতে গোনা কয়েকটা বাদে ইউনিট সম্মেলনগুলো প্রায় সব হয়েছে। আমাদের ১৩২টা ইউনিট আছে সেখানে আমরা ১২০টির সম্মেলন সম্পন্ন করেছি। ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৩টা ওয়ার্ডের সম্মেলন সম্পন্ন করেছি। আর ১৫ থানার মধ্যে একটিরও সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। প্রথমে ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন সম্পন্ন করতে হবে, এরপর নগরের সম্মেলন হবে। সেই সম্মেলন কবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের পর ছাড়া তা সম্ভব না। আগে ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন সম্পন্ন হোক। এটাই কেন্দ্রের নির্দেশনা।

১৭ বছর পর তারিখ ঘোষণা হলেও সেই তারিখে সম্মেলন করতে পারছে না সংগঠনটি। ৩য় দফায় আগামী ১৮ ডিসেম্বর নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও ফের তা পিছিয়ে গেছে। এর আগে চলতি বছর ১ অক্টোবরে নগর সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করলেও তা হয়নি। এরপর ৪ ডিসেম্বর সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী জনসভার কারণে তা পিছিয়ে চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা ১৮ ডিসেম্বর নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলেন, শীর্ষ পর্যায়ের প্রভাবশালী এক নগরনেতার অনাগ্রহের কারণেই নগরের সম্মেলন হচ্ছে না। বারবার সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও তা পিছিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব-বিরোধ দীর্ঘদিনের। সংগঠনে বিবদমান দুটি ধারার একটি অংশ নগর কমিটির সভাপতি ও তিনবারের মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর ওই ধারাটির নেতাকর্মী তার বড় ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। আরেকটি ধারা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৫ সালে। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন যথাক্রমে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কাজী ইনামুল হক দানু। দানু মারা যাওয়ার পর ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর কেন্দ্র থেকে একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেটিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সভাপতি ও নাছিরকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০১৭ সালে ১৫ ডিসেম্বর মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর কমিটির প্রথম সহ-সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর কোনো সম্মেলনও হয়নি, নতুন কমিটিও ঘোষণা করা হয়নি। দীর্ঘদিন পর নগর সম্মেলনের উদ্যোগ নেয়া হলে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে নগরের ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের অধীনে ইউনিট শাখার সম্মেলন শুরু হয়। কিন্তু শুরু থেকেই সম্মেলনস্থল ঘিরে অবস্থান, পাল্টা সম্মেলন ও জ্যেষ্ঠ নেতাকে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ ওঠে।

মহিউদ্দিনের অনুসারীদের সদস্য ফরম না দেয়া, সম্মেলনে তাদের আমন্ত্রণ না জানানো, নগরের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সম্মেলন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না করা, একপক্ষীয় সম্মেলন আয়োজন ও কমিটিতে জ্যেষ্ঠদের বাদ দেয়ার অভিযোগ পাঠানো হয় কেন্দ্রে। এরপর কেন্দ্র থেকে ২৩ ডিসেম্বর ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। তৃণমূলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে পরস্পর বিরোধী দুটি ধারার বিরোধ আরো জোরালো হয়।

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্র থেকে ৫ সদস্যের একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করে দেয়া হয়েছিল। রিভিউ কমিটি কেন্দ্রের অনুমতিক্রমে ১৫ সাংগঠনিক থানার জন্য নগর আওয়ামী লীগের একজন করে নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে ১৫টি সাংগঠনিক টিম গঠন করে। তাদের ইউনিট সম্মেলন নিয়ে অভিযোগ যাচাই-বাছাইপূর্বক দ্ব›দ্ব-সংঘাত নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের সম্মেলন সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বিরোধ মেটেনি। ফলে ইউনিট সম্মেলন শেষ হলেও ওয়ার্ড এবং থানাগুলো ঝুলে আছে।

এ অবস্থায় চলতি বছরের ২৫ মে চট্টগ্রামে এক সাংগঠনিক সভায় এসে কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ঘোষণা দেন। সেটা না হওয়ায় গত ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নগরীর ১৫ থানার সাংগঠনিক টিমের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ৪ ডিসেম্বর নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সময় বেঁধে দেন আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। কিন্তু ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জনসভার কারণে স্থগিত ঘোষণা করে ১৮ ডিসেম্বর সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। সেই তারিখেও সম্মেলন না হওয়ার কথা গতকাল জানালেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App