×

জাতীয়

মামলা-গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০১ এএম

রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত উত্তাপ ছড়ানোর আগেই ফের মামলার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ- সরকার শেষ সময়ে নার্ভাস হয়ে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের। পুরনো মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির স্থানে নাম ঢুকিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। পুরনো মামলায় চার্জশিটও দেয়া হচ্ছে দ্রুতগতিতে। বিচারকাজও চলছে একই গতিতে। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, মামলা ও গ্রেপ্তারে ভীত নন তারা; সব বাধা উপেক্ষা করে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অভিযোগ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে চাপে রাখতে মামলার ফাঁদে ফেলা সরকারের পুরনো কৌশল। তাদের ভাষায়- ‘সরকার এখন নার্ভাস হয়ে পড়েছে। শেষ সময়ে বিরোধীদের দমাতে তারা মরিয়া। তবে শেষ রক্ষা হবে না’। জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে গায়েবি মামলার খেলা শুরু করেছে সরকার। সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি ফ্যাসিবাদী সরকার তখনই এসব আচরণ করে, যখন তাদের সময় শেষ হয়ে আসে। তবে শেষ রক্ষা হবে না। কারণ, এবারের প্রেক্ষাপট ২০১৪ সালের মতো নয়। বিএনপির নেতারা এখন রাজপথ চিনে গেছেন। মামলার ভয়ে ভীত নন তারা। এটা হয়তো সরকার এখনো বুঝতে পারছে না।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে এ ধরনের ১০২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪ হাজার ৪১৮ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ১০ হাজার ৬৬৪। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫০০ জনকে, যারা এখন কারাগারে। দলটির অভিযোগ, এ বছরের জুলাই থেকে ‘গায়েবি’ মামলা দেয়া শুরু হলেও গত ১০ দিনে সারাদেশে এ সংখ্যা বেড়েছে।

এর আগেও ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৫৫১টি মামলা দেয়া হয়। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অন্তত ২ লাখ ২৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছিল। এছাড়া ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে চলা আন্দোলনেও নেতাদের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার মামলা দেয়া হয়। এসব মামলায় নামে-বেনামে প্রায় ৮ লাখের মতো আসামি করা হয়।

তবে মামলা-গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপিও এবার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। ভোলায় বিক্ষোভ মিছিল- সমাবেশে এলোপাতাড়ি গুলিতে ছাত্রদলের একজন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের এক কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে বিএনপি মামলা করেছে। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জে গুলিতে নিহত যুবদল কর্মী শাওন আহমেদ রাজার হত্যার ঘটনায়ও নারায়ণগঞ্জ আদালতে বিএনপি মামলার আবেদন করেছে। এতে নারায়ণগঞ্জের এসপি, এএসপি, ওসি ও ডিবি পুলিশের এসআই মাহফুজুর রহমান কনকসহ ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৫০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। রাজপথের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে গুলির ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মামলা-গ্রেপ্তার নিয়ে বিএনপির অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের ভাষ্য- কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা মামলা থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতেই পারে। আর বিচারকাজ চলছে আইন অনুযায়ী। এখানে কোনো বাড়তি হস্তক্ষেপ বা বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নেই।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সরকারের কাজ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। মানুষের জান-মাল রক্ষা করা। কেউ জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর কিংবা জনজীবনে বিঘœ ঘটালে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। এটি কে বা কারা করল, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। আইন তার নিজের গতিতেই চলবে। আওয়ামী লীগ কি বিএনপির আন্দোলনে ভয় পাচ্ছে? ভয় থেকেই কি এসব ‘গায়েবি’ মামলা হচ্ছে?- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো আন্দোলনকে ভয় পায় না। সব রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কিছু না কিছু অপরাধী আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে। নির্বাচন এলে ওই অপরাধীরা তাদের তৎপরতা শুরু করে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তো ব্যবস্থা নিতেই হয়।

সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা পুরনো মামলা সচল ও নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির আবেদনে উচ্চ আদালতের আদেশে একের পর এক বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলা সচল হচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, জয়নাল আবদীন ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলুর মামলা সচলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, এসব মামলা ওয়ান-ইলেভেনের সময় করা হয়েছে। মামলাগুলোর আইনগত কোনো ধরনের উপাদান নেই। বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুদককে দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পুরনো মামলা সচল করছে।

মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে মাঠের নেতাদের বর্তমান পরিস্থিতি কী- জানতে বিএনপির কয়েজন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, মামলা নিয়ে কর্মীরা ভীত নন। শুধু মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরাই কেউ কেউ দলীয় নির্দেশে কৌশলে গা ঢাকা দিয়ে থাকছেন। তাছাড়া সবাই মাঠে রয়েছেন। নেতারা জানান, পুলিশ মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের পাশাপাশি রাজপথে সক্রিয় কর্মীদেরও ‘অজ্ঞাত আসামি’ হিসেবে গ্রেপ্তার করতে পারে। তাই কোনো মামলায় অজ্ঞাত আসামি দুইশ’ হলেও অন্তত দুই হাজার নেতাকর্মী এ তালিকায় যুক্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, ওই ঘটনার সময় যারা সরাসরি আন্দোলন কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। এরই মধ্যে পুলিশ বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এজাহারভুক্ত আসামির বাইরেও বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

মাঠের নেতারা জানান, ২০১৪ সালের আন্দোলনের পর বিএনপির নেতাকর্মীর নামে অসংখ্য মামলা হয়। সে সময় বছরের পর বছর জেলে কাটালেও কেউ তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর রাখেনি। এমনকি এসব মামলায় আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে দলের পক্ষ থেকে আর্থিক কিংবা অন্য কোনোভাবে সহায়তা করা হয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই নেতাকর্মীদের গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হতো। ফলে এক পর্যায়ে মাঝপথে সেই আন্দোলন থেমে যায়। তবে ৯ বছর পর এসে সেই পুরনো চিত্র পাল্টে গেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিটি মামলার খবর নিচ্ছেন, প্রতিটি বিভাগে তিনি আলাদা করে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন। যারা কর্মীদের মামলা প্রত্যাহারে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন। যারা কারাগারে আছেন, তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তাদের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। দলের পক্ষ থেকে শতভাগ সহায়তা পেয়ে নেতাকর্মীরা এখন উজ্জীবিত। তারা রাজপথের আন্দোলনে পিছপা হচ্ছেন না।

জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম বলেন, এই ফ্যাসিস্ট সরকার গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম দমানোর চেষ্টা করছে। তবে ২০১৪ সালের সেই চিত্র এখন আর নেই। নেতাকর্মীদের মনোবল এখন ইস্পাতের মতো শক্ত। কেউই মামলার ভয়ে পালিয়ে নেই। সবাই বুক ফুলিয়ে রাজপথে আছেন এবং বর্তমান সরকারের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত থাকবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App