×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংক নিয়ে যত কথা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০৯ এএম

ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়- এমন একটি গুজব বেশ ডালপালা ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র ছড়ানো এই গুজব আতঙ্ক সৃষ্টি করছে আমানতকারীদের ভেতর। দেশের অভ্যন্তরেতো বটেই, দেশের বাইরে প্রবাসীদের মাঝেও এর প্রভাব পড়ছে। প্রবাসীদের একটা বড় অংশ খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ, গুজবে কান দিয়ে তাদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল বাদ দিয়ে অবৈধ পথ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করছেন। তাতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান দুই খাত রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার অর্থ রিজার্ভ কমে যাওয়া। সবাই অবহিত যে দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে পাপ্ত। সেই বাজারও ভালো নয়। ইউরোপ-আমেরিকা আমাদের পোশাকের মূল বাজার। সেখানকার অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজমান থাকায় পোশাক শিল্পের রপ্তানি আদেশ কমছে। ক্রেতাদের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে এমনকি শিপমেন্টের স্তরে গিয়ে আটকে যাচ্ছে রপ্তানি। সঠিক সময়ে পেমেন্টও আসছে না কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তাতে দেশে ডলারের সংকট প্রবল হচ্ছে। আমদানিকারক দেশের এই মন্দাদশা কবে কাটবে তার নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে যদি প্রবাসী আয়ে ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে বলাই বাহুল্য যে আমাদের অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে। এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখীন থাকায় আমদানিতে অতিরিক্ত ডলারের প্রয়োজন পড়ছে, এর ওপর প্রবাসী আয় কমে যাওয়া হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। এমন অবস্থা কারো কাম্য হতে পারে না। সবাই নিশ্চয়ই অবহিত আছেন, ব্যাংক তার মোট আমানতের সবটাই বিনিয়োগ করে না, পরিমিত পরিমাণ অর্থ হাতে রেখে দেয় গ্রাহকদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবার স্বার্থে। হাতে রেখে দেয়া অর্থই তারল্য। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় এ মুহূর্তে তারল্যের সংকটতো নেই-ই, বরং অতিরিক্ত তারল্য আছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে সব ব্যাংক মিলিয়ে মোট আমানত আছে ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। এর ভেতর নিয়মানুযায়ী আড়াই লাখ কোটি টাকা তারল্য হলেই যেখানে চলে সেখানে আছে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। [সূত্র প্রথম আলো, ২০ নভেম্বর ২০২২]। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমানতকারীদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ। গুজবটির সূত্রপাত যারা ঘটিয়েছেন তারা অসৎ উদ্দেশ্য থেকে তা করেছেন, অন্যরা বিচার-বিশ্লেষণ না করে পালে হাওয়া দিচ্ছেন। কেউ কেউ একে সরকারবিরোধী প্রচারণার হাতিয়ার করছেন, প্রকারান্তরে যেটি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের শামিল। আতঙ্কের কারণে অতিরিক্ত টাকা বেরিয়ে গেলে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা যেমন হ্রাস পাবে তেমনি বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। অনেকেই হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের সঙ্গে তারল্যকে গুলিয়ে ফেলছেন। রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা বর্তমানে যতটা হচ্ছে, অতীতে কখনোই তা হয়নি। গ্রাম-গঞ্জেও এখন রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা হতে শুনি। সাধারণত ৩ মাসের সমপরিমাণ আমদানি ব্যয় মেটাবার মতো রিজার্ভ থাকলে তাকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। সে পরিমাণ থাকার পরও রিজার্ভ এখন আলোচনায়। এর আগে এর চেয়ে খারাপ সময় পার করলেও এ সম্পর্কিত আলোচনা বিশেষজ্ঞ মহলের বাইরে যায়নি। রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ নিয়ে সরকারের আত্মপ্রসাদ ও প্রচারণা সাধারণ মানুষকে রিজার্ভ চিনিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার এই রিজার্ভ বেশ কিছুদিন ধরে নিম্নমুখী। একদিকে প্রবাসী আয়ে ঘাটতি, অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এর কারণ। ফলে বাজারে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। টাকার মান পড়ে গেছে। পরিত্রাণের উপায় হিসেবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলারের চাহিদা কমানোর চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি মজুত [ডলারের] বাড়ানোর জন্য নেয়া হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ। হুন্ডি রোধ করারও তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে, ফল কী দাঁড়ায় বোঝা যাবে পরে। অর্থ পাচার রোধ এবং আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং নিয়ে সতর্কতার অগ্রগতি কতটুকু হয় সেটি বুঝতেও সময় লাগবে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে। ঋণের বিতরণ মোট ৭ কিস্তিতে ২০২৬ সালে সম্পন্ন হবে। কিস্তিভিত্তিক এই ঋণ দ্বারা ডলার সংকটের আশু সমাধান না হলেও অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ এতে স্বস্তি বোধ করছেন। তার কারণ ভিন্ন। আইএমএফ শর্ত হিসেবে যেসব নীতিমালা মেনে চলার ও সংস্কারের কথা বলছে সেসবের প্রয়োজনীয়তার কথা তারা আগে থেকেই বলে আসছিলেন। সরকার কর্ণপাত করছিল না। এবার বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো। রাজস্ব ও ব্যাংক খাতে সংস্কার, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হ্রাস ইত্যাদি বিষয় প্রদেয় ঋণের শর্তাবলির অন্যতম। মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতিমালা মানাতে চায় আইএমএফ। বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে চায় সুদের হার। দিতে চায় অর্থনীতির তাত্ত্বিক পাঠ। কার্যত বাংলাদেশের বাজার অবাধ নয়। সিন্ডিকেটের প্রাধান্য পদে পদে। কতিপয় শিল্প ও বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে গোটা বাজার ব্যবস্থা। এরা সরকারকেও প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নীতিমালা তৈরি করায় নিজেদের পক্ষে। রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সত্যিই জরুরি। বর্তমান কর-জিডিপি অনুপাত দিয়ে স্বয়ম্ভরতা অর্জন কঠিন। তবে কৃষি ও অন্য অনেক খাতে ভর্তুকি বজায় রাখতে হবে বাস্তবতা বিবেচনায়। সামাজিক নিরাপত্তার বলয় অবশ্যই বাড়াতে হবে। আইএমএফ সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদহার হ্রাসের কথা বলছে। বস্তুত সঞ্চয়পত্র সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেরই উপকরণ। অবসরভোগী বয়স্ক মানুষ সঞ্চয়পত্রের মূল বিনিয়োগকারী। সুদের হার কমিয়ে, করহার বাড়িয়ে, সীমা আরোপ করে ইতোমধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুবিধা অনেক কমানো হয়েছে। যার দরুন সঞ্চয়পত্র বিক্রি অবিশ্বাস্যরকম কমে গেছে। সুবিধা আর সংকুচিত করা উচিত হবে না। ব্যাংকের ঋণের ওপর উচ্চ সুদহার বজায় ছিল স্বাধীনতার পর থেকে। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল সুদহার কমানোর। কিছুদিন আগে মূলত সরকারি নির্দেশনায় ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়। একই সঙ্গে কমানো হয় আমানতের সুদহার। পরিস্থিতি ৯-৬-এর ক্যাপ নামে পরিচিত। আশা করা গিয়েছিল এতে বিনিয়োগ বাড়বে, খেলাপি ঋণ কমবে। বিনিয়োগ কতটুকু বেড়েছে, আবার বাড়ার নামে অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের ব্যাপক ব্যবহার হলো কিনা তা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করি। কেননা অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দেয়। অন্যদিকে আমানতের সুদহার অনেক কমানোয় আমানতকারীদের স্বার্থ যে ক্ষুণ্ন হয়েছে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। ঋণের সুদহার কমানোর অন্য উদ্দেশ্য ছিল খেলাপি ঋণ কমানো। এ উদ্দেশ্য মোটেও পূরণ হয়নি। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। আসলে বড় ঋণ গ্রহীতাদের অনেকে ‘পেশাদার ঋণখেলাপি’। তাদের যত সুবিধাই দেয়া হোক উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। দেশীয় অর্থনীতিবিদদের অনেকে এই ৯-৬-এর ক্যাপ উঠিয়ে দেয়ার দাবি তুলছিলেন, আইএমএফও একই কথা বলল। সাম্প্রতিক ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা এক সুরে বলছেন- ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হচ্ছিল, এখন বিশেষ পরিস্থিতিতে তার বিস্ফোরণ হলো। জ্বালানি তেলের মূল্যের ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য। যদি আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে দেশে জ্বালানির মূল্য নিয়মিত সমন্বয় করা হতো তাহলে সর্বত্র এত উথাল-পাতাল অবস্থা হতো না। আইএমএফ এখানেও হাত দিতে বলছে। তবে জ্বালানিতে এখনো ভর্তুকির আবশ্যকতা আছে। বিপিসি এতকাল হাত গুটিয়ে বসে ছিল, নিজস্ব তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগী থাকেনি। স্থবিরতরা কাটিয়ে তারা যদি এবার সক্রিয় ও সফল হয় তাহলে ভিন্ন কথা। বিদ্যমান ব্যাংক ব্যবস্থায় সংস্কার সাধনের কথা ওয়াকিবহাল মহল দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন। আইএমএফ পুরনো কথাই বলছে। দেশের ব্যাংকগুলোর ভিত আমানতের দিক থেকে শক্তিশালী। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারেও তারা তেমন পিছিয়ে নেই। পিছিয়ে আছে গুণগত বিনিয়োগে। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংস্কারের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়। উদ্দেশ্য আত্মনির্ভর ও স্বকীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদের দাঁড় করানো। বাস্তবে কিছুই হয়নি। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও পরিচালনা পর্ষদ স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবর্তে সরকারের আজ্ঞাবহই থেকে যায়। বেসরকারি ব্যাংক থাকে মালিকদের নিয়ন্ত্রণে। স্বাধীনতা সেখানেও নেই। সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা খুবই উচ্চ বেতনে নিযুক্ত। এটি তাদের বাগে রাখার কৌশল কি না বিবেচনা করা দরকার। সংস্কারের কথা বললে পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে তার মূল কথা। যতদিন পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন গুণগত বিনিয়োগ হবে না, খেলাপি ঋণও কমবে না। অধীনস্থ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন সত্তার বিকল্প নেই। মজিবর রহমান : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App