×

শিক্ষা

পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা-সভাপতির ভূমিকায় রহস্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:৩৪ পিএম

পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা-সভাপতির ভূমিকায় রহস্য

মৌমিতা সাহা। ছবি: ভোরের কাগজ

দীপাবলির প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ছাত্রী মৌমিতা সাহার মৃত্যু নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্থায়ী মন্দিরে দগ্ধ হলে তার শরীরের ৩৫-৪০ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। রুয়েট প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে খোলা জায়গায় আগুনের অনুষ্ঠান করে এমন দুর্ঘটনা ঘটায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে পূজা উদযাপন পরিষদের গাফিলতিকেই দায়ি করছেন অনেকে। এছাড়া ওই পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও সভাপতি পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে আরও বেশি রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

নিহত মৌমিতা রুয়েটের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

জানা যায়, অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ মুস্তাফি পূজা উদযাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে থেকেও মৌমিতার মৃত্যু নিয়ে দেখিয়েছেন চরম উদাসীনতা। নিজে এতো বড় দায়িত্বে থেকেও বাস্তবিক পক্ষে মৌমিতা ও তার পরিবারের জন্য কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর পর মৌমিতাকে নিয়ে নিজের ফেসবুক টাইম-লাইনে দেয়া স্টাটাসে স্ববিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

ফেসবুক স্ট্যাটাস তিনি লেখেন- এই অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এটা কি নিছকই একটি দুর্ঘটনা ছিল? নাকি, কারও ষড়যন্ত্রের শিকার? আগুন লেগে গিয়েছিল নাকি লাগানো হয়েছিল? শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সামনেই আগুন লাগার পর তাৎক্ষণিকভাবে তারা কোনো ব্যবস্থা কেন নেয়নি? তারা কেন দর্শকের ভূমিকায় থাকল? দর্শকের ভূমিকায় না থাকলে তার (মৌমিতা) শরীরের ৪০% বার্ণ কী করে ঘটে?’ তিনি ব্যাপারটিকে হাল্কাভাবে না নিয়ে পুলিশি তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন। তিনি নিজে রুয়েট সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে থেকেও মৌমিতার এমন অকাল মৃত্যুতে ‘পূজা উদযাপন পরিষদ’ ও ‘ছাত্রকল্যাণ দপ্তর’ কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে- ফেসবুকের সেই পোস্টে তিনি ছুড়ে দেন প্রশ্ন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এতো বড় একটি ঘটনা। এটি তদন্তে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কমিটি করা উচিত ছিল। তবে তা হয়নি। আগুন কীভাবে লেগেছিল। রুটিন দায়িত্বের ভিসি দায় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। এমন দুর্ঘটনা ঘটলেও এভাবে তার দায় এগিয়ে চলা অযৌক্তিক।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে- মৌমিতা ঝলসে যাওয়ার পরও অনুষ্ঠানটি চলছিল। পরে রাতের খাবার নিয়েও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। অনুষ্ঠানস্থলে দুইজন আনসার দায়িত্বে থাকায়ও তখন তারা ছিল দর্শকের ভূমিকায়। উপস্থিতরা আগুন নেভানোর পর তাকে রামেক হাসপাতালের নিয়ে যায়। দুই ঘণ্টার চিকিৎসার পর মৌমিতাকে নেয়া হয় ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এই দুই ঘণ্টা এবং ঢাকায় ১০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার সময়েও প্রশাসন থেকে তাকে দেখতে যাননি। আর্থিকভাবে ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের দপ্তর থেকে করা হয়নি সহযোগিতা। এছাড়া ৩ নভেম্বর রাতে মারা যাওয়ার পর তার লাশ হস্তান্তরে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রুয়েটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পূজা উদযাপন পরিষদ সন্ধ্যার পর এতো বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল অথচ অনুমতি না নিয়ে। সেখানে উগ্র মৌলবাদিরা বড় ধরনের হামলাও চালাতে পারতো। মৌমিতা আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন, এর চেয়েও আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। আসলে বিষয়টি হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

রুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি ইসফাক ইয়াসির ইপু বলেন, ‘শিক্ষার্থীর জন্যই আজ তারা শিক্ষক। মৌমিতার বিষয়টির ব্যাপারে প্রশাসন দায় নেয়নি বরং উদাসিনতা দেখিয়েছে। ঢাকায় মৌমিতা মারা যাওয়ার পর আরএমপির মতিহার থানার ক্লিয়ারেন্সের জন্য শাহবাগ থানা পুলিশ লাশটি দীর্ঘক্ষণ আটকিয়েও রেখেছিল। আমি বলার পর প্রশাসন নড়েচরে বসলে এর সমাধান হয়।’

প্রত্যক্ষদর্শী অনিক সাহা (মৌমিতার বিভাগের বড় ভাই) বলেন, ‘প্রশাসনের গাফিলতির বিষয়ে কিছুই বলব না। দগ্ধ হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সে নেয়ার পথে তার কিছু কথা এখনো কানে বাজে। সে মরার পর পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য প্রশাসনে আবেদন করেছিলাম। সাবেক শিক্ষার্থী ও বিভাগের পক্ষ থেকে ফান্ড কালেকশনে শ্রাদ্ধ করেছি।’

নিহত মৌমিতার বাবা রতন কুমার সাহা বলেন, ‘আমার মেয়ে যেভাবেই মারা যাকÑ এটি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর্থিকভাবে কোনো অনুদান দেয়নি।বিষয়টি জানতে রুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের দপ্তরে দুই দিন গিয়েও পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. রবিউল আউয়ালকে পাওয়া যায়নি। দুই দিন অসংখ্যবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

রুয়েটের রেজিস্ট্রার ও বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘ইতোপূর্বে দীপাবলির যত অনুষ্ঠান হয়েছিল সেগুলো আবাসিক হলগুলোর মধ্যে ছোট পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু এবার যে খোলা আকাশের নিচে দীপাবলির অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সে ব্যাপারে প্রশাসনকে জানানো হয়নি। জানতে পারলে সেখানে ফায়ার সার্ভিস কিংবা থানা পুলিশকে অবগত করে রাখতাম। এছাড়া মৌমিতা দগ্ধ হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্স দেয়া থেকে শুরু করে সার্বিক সহযোগিতা করা হয়েছে।’

রুয়েটের ভাইস-চ্যান্সেলর (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমি নতুন মানুষ। ছাত্রকল্যাণ পরিচালক এই খাতে কোনো ফান্ড নেই বলে জানায়। এজন্য তাকে আর্থিক নয়; লোজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছি।

উল্লেখ, রুয়েটের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের (শিক্ষাবর্ষ : ২০১৮-১৯) ছাত্রী মৌমিতা সাহা। গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যার পর দীপাবলির প্রদীপ প্রজ্জ¦লনের সময় রুয়েটের অস্থায়ী মন্দিরে শাড়ীর আচলে আগুন লাগে। অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী তার পাশে থাকার পরও শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে যায়। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় ১০ দিন ঢাকায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ৩ নভেম্বর রাতে হেরে যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App