×

মুক্তচিন্তা

শিলচর-সিলেট উৎসব : বদলে দিতে পারে প্রান্তিক মানুষের জীবনের গল্প

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩৮ এএম

শিলচর-সিলেট উৎসব : বদলে দিতে পারে প্রান্তিক মানুষের জীবনের গল্প

মানুষের ইতিহাস প্রব্রাজনের ইতিহাস। ভাঙা গড়ার ইতিহাস। সৃজন আর বিসর্জনের ইতিহাস। এই ইতিহাসের পথ বেয়ে পিছিয়ে গেলে দেখা যায় যে গুপ্তযুগ থেকে বরাক-সুরমা উপত্যকা অন্তত ৬-৭টি রাজবংশের অধীনে ছিল। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ইতিহাসবিদ ডা. জয়ন্তভূষণ ভট্টাচার্যের মতে, শ্রীহট্টমণ্ডল সমগ্র বরাক-সুরমা উপত্যকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল। ভাটেরা গ্রামে আবিষ্কৃত খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর দুইখানি তাম্র ফলক হলো অবিভক্ত বরাক-সুরমা উপত্যকায় শ্রীহট্ট রাজ্য নামে একটি স্বনির্ভর সার্বভৌম আঞ্চলিক রাজ্যের উত্থানের প্রাচীনতম নিদর্শন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শাসনাধিষ্ট রাজশক্তির দুর্বলতায় এবং প্রতিপক্ষের দুর্নিবার আগ্রাসনে শাসক বদলেছে। সঙ্গে বদলে গেছে খণ্ডরাজ্যের মানচিত্রও। তারপরও বদলায়নি সাধারণ মানুষের ভাষা সংস্কৃতি, আচার সর্বস্বতা আর লোকাচার। দেশ কালের সীমানা উত্তীর্ণ হয়ে তা অমর অমলিন হয়ে থেকে গেছে মানুষের আত্মপরিচয়ে এমনকি আত্মশ্লাঘাতেও। এভাবেই লোকস্মৃতিতে বরাকের মানুষের কাছে সিলেট আজো সজীব রয়েছে সুধাকণ্ঠ ভুপেন হাজারিকার গানের সেই দুটি কলির মতো- ‘একই আকাশ একই বাতাস, এক হৃদয়ের একই তো শ্বাস।’ পলাশীর যুদ্ধের ৮ বছর পর অর্থাৎ ১৭৬৫-তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন দেওয়ানি গ্রহণ করে তখন থেকেই শ্রীহট্ট জেলাও সমগ্র বাংলার সঙ্গে কোম্পানির শাসনাধীন হয়। আসামে ইংরেজ শাসন শুরু হয় তার অনেক পরে। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও কিছু পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে আসাম প্রদেশ গঠন করে। তখনই শ্রীহট্ট ও কাছাড় জেলাকে সুরমাভ্যালি ডিভিশন নাম দিয়ে একটি নতুন বিভাগ তৈরি করা হয়। তার আগে আসাম বাংলাদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের শাসনাধীন ছিল। ১৯০৫ এ গঠিত হলো পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ। তারপর আবার ১৯১২-তে প্রশাসনিক স্বার্থে পরিবর্তন। গঠন হলো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। যে রাজস্বের ঘাটতির জন্য ১৯০৬-তে সিলেট কাছাড়, গোয়ালপাড়াকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ১৯৪৭ এর গণভোটে সিলেটের মাত্র সাড়ে ৩টি থানা আসামের বরাক উপত্যকায় রেখে বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে দেয়া হলো। ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটের মধ্যেই নিহিত আছে বরাক-সুরমা উপত্যকার মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ভিত। দুটি অঞ্চলের মানুষের এই কালোত্তীর্ণ বন্ধন আর সৌসাদৃশ্যকে নতুনভাবে তুলে ধরে আধুনিক জনজীবনের পরতে পরতে যাতে প্রতিফলিত করা যায় তার অন্বেষণেই শিলচরে ২ থেকে ৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শিলচর-সিলেট উৎসব। এই উৎসবে নদীপথ, জলপথের প্রসারের আরো সম্ভাবনা, শিক্ষা স্বাস্থ্য বাণিজ্য বিপণনের উন্মেষ, কৃষ্টি সংস্কৃতির আদান-প্রদান নিয়ে থাকবে বাস্তবের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে তথ্য নির্ভর আলোচনা। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আরো অধিক গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন কেন আছে তা নিয়ে এখানে সম্যক আলোচনা দরকার। ২০২২ সাল ভারত বাংলাদেশ দুটি দেশের জন্যই এক যুগান্তকারী বছর। ভারত এ বছর স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রম করেছে এবং বাংলাদেশ পালন করছে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। এই দীর্ঘ সময়কালে দুদেশের মানুষেরই যাপনকথায় এসেছে উল্লেখযোগ্য উত্তরণ। দুটি দেশেরই আছে অতুলনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশাল যুবশক্তি, জল ও সড়কপথে বাণিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগের পথ ছিল নদীপথ। চীনা পরিব্রাজকরাও নদীপথেই এ অঞ্চলে এসেছিলেন। হিউয়েন সাঙ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ভাস্কর বর্মার আমন্ত্রণে কামরূপে আসেন। হিউয়েন সাঙ বা ফা-হিয়ানের মতো পর্যটকরা বাংলার এক জনপদ থেকে আরেক জনপদ ঘোরাঘুরি করে শুধু আন্তঃদেশীয় নয় বহিঃদেশীয় পথেরও বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। প্রাচীনকালে বাংলাদেশ থেকে তিনটি প্রধান পথ পশ্চিম দিকে বিস্তৃত ছিল। নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস আদিপর্বে লিখেছেন, ‘একটি পুন্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ হইতে মিথিলা বা উত্তর-বিহার ভেদ করিয়া চম্পা (ভাগলপুর) হইয়া পাটলিপুত্রের ভিতর দিয়া বুদ্ধগয়া স্পর্শ করিয়া (অথবা পাটনা-আরা) হইয়া বারানসী-অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; সেখান হইতে একেবারে সিন্ধু সৌরাষ্ট্র গুজরাটের বন্দর পর্যন্ত।’ আরেক বিদেশি পর্যটক ইবনে বতুতা চীন যাওয়ার পথে সমুদ্রপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি যে স্থানে প্রবেশ করেছিলেন তার নাম লিখেছেন সোদকাওয়ান। এই নামটি সাতগাঁওর সঙ্গে অভিন্ন হলেও বর্তমানে সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে এটি আসলে চট্টগ্রাম। ইবনে বতুতার বিবরণীতে আছে যে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিলেটে গিয়ে হযরত শাহজালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সিলেট থেকে ফিরতি পথে তিনি সোনারগাঁ আসেন এবং সেখান থেকে জাহাজে করে জাভায় চলে যান। অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের সঙ্গে নদীপথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেই নয় সংস্কৃতির আদান-প্রদানের জন্যও মানুষ নদীপথ চলাচলের জন্য বেছে নিত। ইংরেজরাও একই উদ্দেশ্যে নদী পারেই সমস্ত শহর স্থাপন করেছিল। রেল-বিমান-স্থলপথের সম্প্রসারণের ফলে আজ নদীপথ তার গুরুত্ব হারাতে বসেছে। তাই শিলচর-সিলেট উৎসবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে নদীপথ উজ্জীবনের যে প্রয়াস রাখা হয়েছে তা শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, দুদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপণন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে এক মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ হতে পারে। ইতোমধ্যে ভারত সরকার জাতীয় জল প্রকল্পের অধীনে বরাক নদীকে ১৬ নম্বর জলপথ হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেখা গেছে যে বরাক নদী তার প্রবাহিত পথের কিছু কিছু অঞ্চলে অতি সংকুচিত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে একসময় যে পথ দিয়ে জাহাজ চলতে পারত আজ তা এক অলীক কল্পনা। তাই নদীর খননের কাজ যেমন শুরু হচ্ছে তেমনি বরাক উপত্যকার বদরপুরঘাটে একটি বিমানবন্দর স্থাপনেরও ঘোষণা হয়েছে। আরেকটি বন্দর হয়তো শিলচরে স্থাপন হতে পারে। দেখা গেছে প্রতি এক টন সামগ্রী স্থলপথে বহন করতে যেখানে দেড় টাকার প্রয়োজন হয় সেখানে জলপথে নিতে মাত্র ৩৫ পয়সা লাগে। দ্বিতীয়ত জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানিরও খুব একটা প্রয়োজন হয় না। এভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে যদি পণ্য সামগ্রী বরাক নদী হয় চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে পারে তবে সেখান থেকে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব। ভারতবর্ষের বর্তমান কেন্দ্রীয় নৌপরিবহনমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল একজন আসাম সন্তান। তাই এক্ষেত্রে তার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। তাছাড়া শিলচর সিলেট উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা শিলচরের সাংসদ ডা. রাজদীপ রায় দীর্ঘদিন থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড় করে দুটি দেশের সীমান্ত সংলগ্ন মানুষের উৎপাদিত সামগ্রী যাতে বিশ্ববাজারে বিপণনের সুযোগ পায় সে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বস্তুত কারু ও হস্তশিল্পে বাংলাদেশ হামেশাই নিপুণ কারিগর সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া পাট সহজজাত হওয়ায় বাংলাদেশের বস্ত্রের সুনাম প্রাচীনকালেই ছিল। চীনা পরিব্রাজকদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। তাদের বিবরণেই আছে যে বাংলার মসলিন বস্ত্র অবশ্যই বিদেশিদের আকর্ষণ করত। এমন সূ² বস্ত্র তখন বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যেত না। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে যদি যোগাযোগের পথ শর্তসাপেক্ষে উন্মুক্ত হয় তবে এ অঞ্চলের মানুষ সহজেই শিলচর গুয়াহাটি হয়ে ভুটান নেপালের বাজার ধরতে পারবে। শিলচর হয়ে মোরে বার্মা পর্যন্ত যাওয়া তখন খুব একটা অসাধ্য নয়। উত্তর-পূর্বের মানুষ যদি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে একটি করিডর পায় তবে সহজেই কলকাতা হয়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গায় পৌঁছতে পারবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই করিডরের বিনিময়ে রাজস্ব আদায় করে আয়ের পথও করতে পারে। এতে বাংলাদেশ যেমন লাভবান হবে, তেমনি লাভবান হবে এ অঞ্চলের মানুষও। তাই শিলচর-সিলেট উৎসব, শুধু বিনোদনের এক উৎসব মাত্র নয়। এ উৎসবে আলোচ্য বিষয়গুলোকে যদি বাস্তবের পরশ দেয়া যায় তবে বদলে যাবে সীমান্তের দুপুরের মানুষের জীবনের চালচিত্র। শিলচর-সিলেটের মানুষের যাপনকথার অগুনতি সাদৃশ্যের মধ্যে প্রান্তিক মানুষের জীবনের যে অপ্রাপ্তি আর যোগ্যতার যে অবমূল্যায়ন এ উৎসবের হাত ধরেই হোক এ অমানিশার পর এক নতুন ভোরের সন্ধান। এ আশাতেই হোক আমাদের নিশি জাগরণ।

দীপঙ্কর ঘোষ : কলাম লেখক ও গল্পকার, শিলচর, আসাম। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App