×

মুক্তচিন্তা

ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব : মানবকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দৃষ্টান্ত তৈরির পথে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:৫২ এএম

ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব : মানবকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দৃষ্টান্ত তৈরির পথে

পূর্বতন জি২০-এর ১৭টি সভাপতিত্ব অন্য ফলাফলগুলোর মধ্যে ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, যুক্তিগ্রাহ্য আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থা, দেশগুলোর ওপর থেকে করের বোঝা কমানোকে সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফলপ্রদান করেছে। এসব অর্জিত ফল থেকে আমরা লাভবান হব এবং এগুলোর ওপরে দাঁড়িয়ে নিজেদের আরো গড়ে তুলব। যাই হোক না কেন, ভারত যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি- এখনো কি জি২০-এর আরো অগ্রগতি হতে পারে? সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতার উপকার করার জন্য একটি মৌলিক মানসিকতা পরিবর্তনকে অনুঘটক করতে পারি? আমি বিশ্বাস করি, আমরা পারি। আমাদের পরিস্থিতি দ্বারা আমাদের মানসিকতা তৈরি হয়। ইতিহাসজুড়ে মানবসভ্যতা অভাবের মধ্যে বাস করেছিল। আমরা সীমিত সংস্থানের জন্য লড়াই করেছিলাম কারণ আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করত অন্যদের সেই সংস্থানের অধিকারকে অস্বীকারের দ্বারা। ভাবনা, আদর্শ এবং ব্যক্তি পরিচয়ের মধ্যে সংঘাত এবং প্রতিযোগিতা আদর্শ হয়ে উঠেছিল। দুর্ভাগ্যবশত আজো আমরা সেই একই শূন্য মানসিকতার ফাঁদে আটকে রয়েছি। যখন দেশগুলো ভূখণ্ড এবং সম্পদ নিয়ে লড়াই করে আমরা তখন এটি দেখি। আমরা এটা লক্ষ্য করি যখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ অস্ত্রশস্ত্রে পর্যবসিত হয়। আমরা এটা দেখি যখন কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় কয়েকজনের দ্বারা প্রতিষেধকের মজুতদারি হয়। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করতে পারেন এই বলে যে, সংঘাত ও লোভ মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। আমি এর সঙ্গে একমত নই। মানুষ যদি সহজাতভাবেই স্বার্থপর হতো, তাহলে আমাদের মৌলিক এককত্বের প্রচারে এই বিপুলসংখ্যক পারলৌকিক ঐতিহ্যের যে দীর্ঘস্থায়ী আবেদন, সেটার ব্যাখ্যা কী? পঞ্চতত্ত্ব ভারতে জনপ্রিয় এমনই একটি মতবাদ, যা বিশ্বাস করে যে সমস্ত জীবিত সত্তা এমনকি সব নির্জীব পদার্থও মৃত্তিকা (পৃথিবী), জল, আগুন, বায়ু ও স্থান (স্পেইস)- এই পাঁচটি মৌলিক উপাদানে নির্মিত। আমাদের শারীরিক, সামাজিক ও পরিবেশগত মঙ্গলের জন্য আমাদের প্রত্যেকের অভ্যন্তরে ও সবার মাঝে এই উপাদানগুলোর মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব এই বিশ্ব একতার ভাবনাকে প্রচার করার জন্য কাজ করবে। এই কারণে আমাদের মূলভাব হলো- ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’, এটি শুধু একটি বুলি বা সেøাগান নয়। মানব পরিস্থিতির সাম্প্রতিক পরিবর্তন এর মধ্যে বিবেচনাধীন, যেটি আমরা সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আজ আমাদের কাছে পৃথিবীর সব মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করার সংস্থান রয়েছে। আমাদের টিকে থাকার জন্য লড়াই করার দরকার নেই- আমাদের যুগে একটি যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। অবশ্যই কোনো যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। আজ, সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জের আমরা মুখোমুখি হয়েছি, তা হলো- জলবায়ুর পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ এবং অতিমারি- যা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে সমাধান করা সম্ভব নয়, বরং একসঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে করা সম্ভব। সৌভাগ্যবশত, আজকের প্রযুক্তি আমাদের বিস্তৃত আকারে মানবজাতির সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার পথও প্রদর্শন করে থাকে। আমরা আজ যে বিশাল ভার্চুয়াল বিশ্বে বসবাস করি তা ডিজিটাল প্রযুক্তির বিন্যাসকে প্রদর্শন করে। মানবতার ছয় ভাগের এক ভাগ বসতিসহ এবং ভাষাগত, ধর্মগত, প্রথা এবং বিশ্বাসগতভাবে প্রচুর বৈচিত্র্যসহ ভারত হলো বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাচীনতম প্রথাসহ গণতন্ত্রের ভিত্তিগত ডিএনএ প্রদানে ভারতের অবদান রয়েছে। গণতন্ত্রের জননী হিসেবে ভারতের জাতীয় সচেতনতা কঠোর নির্দেশ দ্বারা চালিত নয় বরং একই সুরে লাখ লাখ স্বাধীন কণ্ঠের সমন্বয়ের দ্বারা চালিত। আজ ভারত একটি দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। আমাদের নাগরিককেন্দ্রিক শাসনের রূপকল্প আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত তারুণ্যের সৃজনশীল প্রতিভাকে লালন করার পাশাপাশি আমাদের সর্বাধিক প্রান্তিক নাগরিকদেরও খেয়াল রাখে। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের জাতীয় বিকাশকে একটি আপাদমস্তক শাসন পরিচালনার অনুশীলন না করে বরং নাগরিক নেতৃত্বাধীন ‘গণআন্দোলন’ রূপে গড়ে তুলতে। ডিজিটাল পণ্য তৈরি করার জন্য আমাদের শক্তিশালী প্রযুক্তি রয়েছে যেগুলো উন্মুক্ত, ব্যাপক এবং আন্তঃচালিত। এগুলো সুরক্ষা, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং ইলেকট্রনিক পেমেন্টের মতো ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতি প্রদান করেছে। এসব কারণের জন্য, সম্ভাব্য বৈশ্বিক সমাধানে ভারতের অভিজ্ঞতা অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে। আমাদের জি২০ প্রেসিডেন্সি চলাকালে আমরা ভারতের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও মডেলগুলোকে অন্যদের জন্য, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য সম্ভাব্য টেমপ্লেট হিসেবে উপস্থাপন করব। আমাদের জি২০ অগ্রাধিকারগুলো কেবলমাত্র আমাদের জি২০ শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই গঠিত হবে তা নয়, বিশ্বের দক্ষিণ দিকের আমাদের সহযাত্রীদের সঙ্গেও আলোচনা করে গঠিত হবে, যাদের কণ্ঠস্বর প্রায়ই অশ্রæত থাকে। আমাদের অগ্রাধিকারগুলোর নজর কেন্দ্রীভূত থাকবে ‘এক পৃথিবী’র নিরাময় সাধন, ‘এক পরিবার’-এর মধ্যে সম্প্রীতি আনয়ন ও ‘এক ভবিষ্যৎ’-এর প্রতি আশা প্রদান করার দিকে। আমাদের গ্রহের নিরাময়ের জন্য আমরা প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ততার প্রতি ভারতের ঐতিহ্যের ওপরে ভিত্তি করে স্থিতিশীল এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রাকে উৎসাহ জোগাব। আমাদের মানব পরিবারের মধ্যে সমন্বয়ের প্রচারের জন্য আমরা খাদ্য, সার এবং ওষুধ পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহকে রাজনীতি মুক্ত করতে চাইব, যাতে ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ মানবিক সংকটে পরিণত না হয়। আমাদের নিজেদের পরিবারের মতোই যাদের সব থেকে প্রয়োজন বেশি তারা অবশ্যই সবসময় আমাদের প্রথম চিন্তার কারণ। আমাদের আগামী প্রজন্মের আশাকে অনুপ্রাণিত করার জন্য আমরা সব থেকে ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সৎ আলোচনার জন্য উৎসাহ জোগাব যাতে গণধ্বংসের জন্য অস্ত্রের হুমকিকে প্রশমিত করা এবং বৈশ্বিক শান্তিকে বৃদ্ধি করা যায়। ভারতের জি২০ এজেন্ডা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, উচ্চাকাক্সক্ষী, কর্মভিত্তিক এবং সিদ্ধান্তমূলক। ভারতের জি২০ সভাপতিত্বকে আসুন আমরা একযোগে নিরাময়, সমন্বয় এবং আশার সভাপতিত্ব হিসেবে তৈরি করি। মানবকেন্দ্রিক বিশ্বায়নের একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে আসুন আমরা একযোগে কাজ করি।

শ্রী নরেন্দ্র মোদি : প্রধানমন্ত্রী, ভারত। সৌজন্যে : ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App