×

জাতীয়

দেশের দুগ্ধ খাতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ১১:০৯ এএম

দেশের দুগ্ধ খাতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি

ফাইল ছবি

দেশে প্রতিদিন মাথাপিছু যে পরিমাণ দুধের চাহিদা তা পূরণ করা যাচ্ছে না। উৎপাদনের ঘাটতি পূরণে আমদানি করা দুধেও প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে গবাদি পশু পালন তথা দুধ উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে উন্নতমানের গরু মহিষ পালনে আধুনিক খামার বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন তারা। একইসঙ্গে ডেইরি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন তারা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীতে জনপ্রতি দিনে এক কাপ করে দুধ পান করতে হলে দিনে দরকার প্রায় ১০ লাখ লিটার দুধ। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা আর বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরে দিনে ৫ লাখ লিটার দুধও বিক্রি হয় না। পুষ্টিবিদদের হিসাবে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে অন্তত এক কাপ দুধ খাওয়া উচিত। কেননা, প্রাণিজ আমিষ হিসেবে দুধের বিকল্প নেই। আর দুধ মানবদেহের খর্বাকৃতি রোধসহ দৈনিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে সক্ষম। তবে দুধের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে পুষ্টি নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা। এক্ষেত্রে দেশে দুধের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

দেশের ডেইরি খাতে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে উৎপাদন, দুধের দাম, মানসম্পন্ন দুধ ও বাজারে দুধের সহজলভ্যতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এমন বাস্তবতায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ

মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পাঁচ বছর মেয়াদি ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’ (এলডিডিপি) বাস্তবায়ন করছে। যে প্রকল্পে এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে বিশ্বব্যাংক। যার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে। যদিও এক বছরের মাথায় করোনা মহামারির ধাক্কায় প্রকল্প ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

প্রকল্প সূত্র মতে, ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেইসঙ্গে প্রাণিসম্পদ তথা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, পোল্ট্রির উৎপাদন দক্ষতাও বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী দুগ্ধ খামারিদের দক্ষতা উন্নয়ন, দুগ্ধ বিপণনের জন্য বাজার সংযোগ বাড়বে। পাশাপাশি পণ্য বহুমুখীকরণ, মূল্য সংযোজন, স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাছাড়া প্রাণিজাত আমিষের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ফুড চেইনের সব পর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দুধ-মাংস উৎপাদনকারী, পরিবহনকারী, ব্যবসায়ী, কারিগর, ভোক্তা ইত্যাদি স্তরে সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। প্রকল্পের অধীনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ম্যাচিং গ্র্যান্ট পদ্ধতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারশ ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার স্থাপন করা হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে ২০টি ডেইরি হাব স্থাপন, পশু জবাই ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের জন্য মেট্রোপলিটন পর্যায়ে তিনটি এবং জেলা পর্যায়ে ২০টি পশু জবাইখানা নির্মাণ করা হবে। এছাড়া উপজেলা বা গ্রোথ সেন্টার পর্যায়ে ১৯২টি স্লটার স্লাব অথবা মাংসের বাজার উন্নয়ন, গবাদি পশুর বর্জ্য ব্যবহার করে বিকল্প জ্বালানি তথা বায়োগ্যাস প্রকল্প স্থাপন করা হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে বর্তমানে গবাদি পশুর সংখ্যা ৪ কোটির বেশি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সীমিত জনবলসহ বেসরকারি পর্যায়ের পেশাজীবীরা এসব প্রাণির স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। দেশে যেসব পরিবারের একটি মাত্র গাভীই জীবিকার অবলম্বন সময়মতো চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার দেশে প্রমবারের মতো ভ্রাম্যমাণ প্রাণি চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। মোবাইল ভেটেরিনারি এই ক্লিনিক সেবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের জন্য দ্রুতগতির বাহন। একই সঙ্গে জরুরি চিকিৎসা সেবার প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতিও থাকছে। থাকছে শল্য চিকিৎসা সরঞ্জামও।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস এসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, মিল্ক কনজাংশন এওয়ারনেস বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে দুগ্ধজাত প্রাণির জেনেটিক উন্নয়ন দরকার। হিট টলারেন্স হাই ইল্ডিং ভ্যারাটিস ব্রিড ইনট্রোডিউস করতে হবে। এতে করে যেখানে আমরা এখন দুই থেকে ৩ কেজি দুধ পাচ্ছি, সেখানে ১০ থেকে ১২ কেজি দুধ পাব। ফলে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমবে বলে মনে করেন তিনি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশিকুর রহমান বলেন, প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা অবশ্যই ভালো। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ মিলে মাঠ পর্যায়ের তথ্যেরভিত্তিতে এটি করা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের ওপর।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করা একটা চ্যালেঞ্জ। এলডিডিপি যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে নিঃসন্দেহে ডেইরি শিল্পের জন্য ভালো। আমার জানা মতে, তারা মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করছে। এই কাজটি করতে পারলে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য লাভবান হবে। একটি স্ট্রং চেইন তৈরি হবে, যার মাধ্যমে সহজে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। ছোট ছোট আকারে কৃষকদের বিভিন্ন ইউনিটি করা, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি কিছু ডেইরি যন্ত্রপাতি দিয়ে সাপোর্ট তৈরি করা- এগুলো খুবই পজেটিভ। দুধ উৎপাদনের বিষয়টা হঠাৎ করেই পরিবর্তন হবে- বিষয়টা সেরকম না, এটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। ৫ বছর পর বোঝা যাবে-প্রকল্পের সফলতা কতটুকু। তবে এলডিডিপি প্রকল্পের যতটুকু দেখেছি- তাতে আমার কাছে খুবই পজেটিভ মনে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, মাঠে এক্সটেনশন ওয়ার্কাররা বা এক্সটেনশন পরিকল্পনাগুলো কিভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, প্রযুক্তিগুলো বাংলাদেশে বাস্তবায়নের সুযোগ কতটুকু- এ বিষয়গুলোর সঙ্গে প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করবে। সর্বোপরি ডেইরি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খামারি, মাঠকর্মী, এনজিও, ডিএলএস, বিশ্ববিদ্যালয়, ডেইরি বিজ্ঞানি, শিক্ষক ও এক্সপার্ট সবার সমন্বয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি কামমান করছি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, এলডিডিপির ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পের সময় আরো ২ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। করোনায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে। সে সময় আমরা প্রায় ৬ লাখ খামাররিকে ৭শ কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছি। প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে সারাদেশে ৫ হাজার ৫শ গ্রুপ তৈরি করেছি। সেখানে আমরা নানা সহায়তা দিচ্ছি। ভ্যাকনিনেশনে সহায়তা দিচ্ছি।

তিনি বলেন, দুধ পঁচনশীল দ্রব্য হওয়ায় এটাকে সংরক্ষণের পাশাপাশি ন্যায্য মূল্য পেয়ে খামারিরা যেন আরো উৎসাহিত হয়ে দুধ উৎপাদনে এগিয়ে আসে। সেজন্য সারাদেশে চারশ ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার স্থাপন করেছি। দুধ সহজে বাজারজাত করতে পারে সেজন্য কালেকশন সেন্টারের পাশাপাশি কুলিং প্ল্যান্ট তৈরি ও যানবাহনের ব্যবস্থা থাকবে যেন তারা দুধ পরেরদিনও বিক্রি করতে পারে। এছাড়া দেখা যায় অনেক সময় অনেকেই দুধ খেতে পারেন না বা হজম হয় না। সেটাকে কীভাবে আরো সহজে পার্স্যু করা যায়- এই কাজগুলো প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা করছি। তবে আমরা এটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাই না। এ খাতকে কীভাবে আরো বড় পরিসরে এগিয়ে নেয়া যায় অর্থাৎ ২০৪১ সালের বাংলাদেশে মাথাপিচু ৩শ এমএল দুধ সবার জন্য যেন নিশ্চিত করতে পারি-সেভাবে আমরা কাজ করছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App