×

জাতীয়

সিন্ডিকেটের কবলে প্রাথমিকের বই ছাপা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ০৮:১৭ এএম

সিন্ডিকেটের কবলে প্রাথমিকের বই ছাপা

ফাইল ছবি

সিন্ডিকেটের কবলে প্রাথমিকের বই ছাপা

ছবি: সংগৃহীত

এনসিটিবিকে দায়িত্ব দিয়ে সংকট কাটানো হয়েছে : প্রাথমিক সচিব
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বই বিতরণ শাখার সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান, গবেষণা কর্মকর্তা নবীর উদ্দিন ও সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুনের সমন্বয়ে ‘সিন্ডিকেটের’ উৎপাতের কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন প্রেস মালিকরা। ‘আম্বার’ ও ’পারট্যাক্সে’র কারখানা থেকে বাধ্যতামূলক কাগজ কেনাসহ ‘অদ্ভুত ও উদ্ভট’ শর্তারোপ করায় প্রেস মালিকরা পাঠ্যবই ছাপানো বন্ধের মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিও বলেছে, এসব বিষয় শিক্ষাঙ্গন ও প্রকাশনা শিল্পকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলার পাশাপাশি সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থায় নিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে গত ১৪ বছর ধরে কর্মরত ‘ক্ষমতাধর’ সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুনই মূলত সিন্ডিকেটের হোতা। তিনিই ছাপাখানার মালিকদের বলেন, ওই কোম্পানি থেকে কাগজ কিনতে হবে। সেই শর্ত ব্যত্যয় করে বই ছাপালেও তারা বই ছাপানোর টাকা পান না। মাহফুজার চোখরাঙানি উপেক্ষ করে গত বছর পাঠ্যবই ছাপানোর টাকা এখনো পাননি তারা। বছরে পর বছর এই সিন্ডিকেটের উৎপাতে অতিষ্ঠ ছাপাখানার মালিকরা এবার পাঠ্যবই ছাপানোই বন্ধ করে দিয়ে বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দায়িত্ব নিয়ে বলছে না প্রাথমিকের ছাপানো বইয়ের টাকা এনসিটিবি থেকে দেয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ছাপার কাজ শুরু হবে না। কারণ গত বছর পাঠ্যবই ছাপানোর টাকা এখনো পাননি বহু ছাপাখানার মালিক। প্রসঙ্গত, মাধ্যমিকের বই ছাপানোর টাকা প্রেস মালিকরা এনসিটিবি থেকে পেলেও প্রাথমিকের বই ছাপানোর টাকা আনতে হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে। ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রাব্বানী জব্বারের এক কোটি টাকার বিল এখনো আটকে রয়েছে। উপরন্তু, ওই টাকা দেয়ার সুপারিশ করে নথি উত্থাপন করায় সিন্ডিকেট থেকে এক কর্মকর্তাকে অন্য শাখায় বদলি করে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ভাই হলেন আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রাব্বানী জব্বার। ছাপাখানার মালিকদের এমন হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সচিব যৌথভাবে গত সোমবার প্রেস মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জানতে চাইলে গবেষণা কর্মকর্তা নবীর উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, বই ছাপানোর দায়িত্ব এনসিটিবির ওপর, কোনো কথা বলতে হলে তারা বলবে। এনসিটিবি দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও টাকা দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং অধিদপ্তরের পক্ষে প্রেস মালিকদের বিভিন্ন শর্ত দেন, কোন কোম্পানি থেকে কাগজ কিনে বই ছাপাতে হবে তাও বলে দেন আপনারা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে পারছি না। সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান স্বীকার করে বলেন, আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রাব্বানী জব্বারের টাকা পরিশোধ সংক্রান্ত নথি উত্থাপন করায় আমাকে ওই শাখা থেকে বদলি করে দেয়া হয়েছে। তাহলে সিন্ডিকেটের কথা সত্য- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা মাহফুজা বলতে পারবে। কিন্তু মাহফুজা ম্যাডামকে অফিসে গিয়ে ও পরে ফোনে পাওয়া যায়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাকে আপনারা পাবেন না। তার কথামত কাজ না হলে সে প্রেস মালিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। তবু তাকে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছু বলেন না। গত ১৪ বছর ধরে অধিদপ্তরে কর্মরত জানিয়ে আক্তারুজ্জামান বলেন, মাহফুজার বড় ক্ষমতা রয়েছে। আমাকে এর মধ্যে টানাটানি করবেন না। এ বিষয়ে গবেষণা কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুনের বক্তব্য জানতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে তার কক্ষে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিয়েও সংযোগ স্থাপন করা যায়নি। প্রেস মালিকরা অভিযোগ করেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কথামত কাগজ কিনে বই ছাপিয়ে দিয়ে প্রেস মালিকরা পথে বসে যাবে। কারণ এবার এমনিতেই কাগজের দাম বেশি, তারওপর পারট্যাক্সসহ এই কোম্পানি থেকে কাগজ কিনতে হলে টনপ্রতি খরচ পড়বে ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার পর্যন্ত। প্রেস মালিকদের কথা হচ্ছে, শর্তানুযায়ী আমরা আমাদের মতো করে কাগজ কিনে বই ছাপিয়ে দেব। কিন্তু এটি মানছে না অধিদপ্তর। এমনকি কিছু প্রেস মালিক বই ছাপিয়ে উপজেলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা চালানে সই না করেই বইগুলো রেখে দিচ্ছেন। এতে কী অসুবিধা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রেস মালিক বলেন, চালানে সই না হলে ওই প্রেস মালিক বই ছাপানোর বিল পাবেন না। চালানে কেন সই হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সিন্ডিকেটের কথামত কাগজ দিয়ে বই ছাপানো হয়নি। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান ভোরের কাগজের কাছে স্বীকার করে বলেছেন, চালানে সই ছাড়াই তিনি তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির কিছু বই বুঝে নিয়েছেন। জানতে চাইলে আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রাব্বানী জব্বার ভোরের কাগজকে বলেন, পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য আমরা যখন চুক্তি করি তখন আইন অনুযায়ী যা যা শর্ত থাকে তা মেনেই চুক্তি করি। তবু চুক্তির পর নতুন ইস্যু নিয়ে ঝামেলা তৈরি করে। এ কারণে আমি এবার প্রাথমিকের বই ছাপানো নিয়ে কোনো কাজই করছি না। গত বছরের বিল না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এটা নিয়ে কিছু লেখার দরকার নেই। বিল পাওয়ার একটি প্রসেস শুরু হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহম্মেদ ভোরের কাগজকে বলেন, কে মাহফুজা, কে নবীর আর কে আক্তারুজ্জামান তা আমার দেখার দরকার নেই। প্রাথমিকের বই ছাপানো নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা গতকাল এক বৈঠকে বসে নিরসন করে দিয়েছি। আজ চিঠি দিয়ে তা আনুষ্ঠানিকভাবে বলে দেব। নতুন নিয়মে বই ছাপিয়ে প্রেস মালিকরা সরাসরি এনসিটিবি থেকে টাকা নিয়ে যাবেন। এজন্য আমরা এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে আগেই টাকা দিয়ে দেব। মানসম্মত বই ছাপানো না হলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও পরিদর্শনকারী সংস্থা আমাদের জবাব দেবে। এর ফলে প্রেস মালিকদের আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কারো কাছে যেতে হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App