×

মুক্তচিন্তা

জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ১২:২৫ এএম

এক সময় জঙ্গি ইস্যুটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও কিছু বড় অ্যাকশনের পর ধারণা করা হচ্ছিল, জঙ্গিরা নির্মূল না হলেও তারা আর বড় কোনো অঘটন ঘটানোর সক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু গত ২০ নভেম্বর আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হোসেন ওরফে শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ও মো. আবু সোহেল ছিদ্দিক ওরফে সাকিবকে ফিল্মি কায়দায় ছিনিয়ে নেয়ার পর আবার জঙ্গি ইস্যুটি সামনে এসেছে। বাংলাদেশে আলোচিত জঙ্গি হামলা শুরু হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় জেএমবির সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। সেই সময় দেশের আদালত চত্বর ও পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হয়। দেশের আহমদিয়া মসজিদে হামলা, সংখ্যালঘু হত্যা, গির্জার পুরোহিতকে হত্যা কিংবা নোয়াখালীর এক মসজিদের ইমামকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারি ক্যাফেতে এবং ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই বেদনাদায়ক। এই দুই হামলায় যেভাবে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়েছে, তাতে মানুষ মাত্রই লজ্জিত হবেন। বিনা দোষে এভাবে মানুষ হত্যা করে জঙ্গিরা আসলে কী অর্জন করতে চায়, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। জঙ্গিদের ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার প্রাথমিকভাবে নমনীয়তা দেখালেও আন্তর্জাতিক চাপে তাদেরও কঠোর অবস্থান নিতে হয়েছিল। বর্তমান সরকার অবশ্য আগাগোড়া জঙ্গি ইস্যুতে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। একটি খবর থেকে জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি), জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলামসহ ৪০টি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের ৪ হাজার ৮৮১ সদস্যকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৪৫৬ জন জামিন পান। সিটিটিসির ধারণা, জামিন পাওয়ার পর লাপাত্তা হওয়া ২৫১ জনের অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নাম-ঠিকানা বদল করে আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছেন। কারাগারে থাকা জঙ্গিরা বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বড় কিছু ঘটানোর পরিকল্পনা করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। এটা মনে করা হচ্ছে যে, জঙ্গিদের ব্যাপারে সবসময়ই সমান সতর্ক থাকতে হবে, গাফিলতি ও শিথিলতা দেখানোর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকায় একটি বড় নাশকতার পরিকল্পনা জঙ্গিদের ছিল। পান্থপথের একটি আবাসিক হোটেলে পুলিশের অভিযানে এক জঙ্গি নিহত হয়েছিল। আগেভাগে জানা না গেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। তার কয়েক দিন আগে মিরপুর মাজার রোডের একটি বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী হয়েছে কয়েক জঙ্গি। ওই বাড়িতে যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুত করা হয়েছিল, তা থেকে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে- এমন ধারণা সত্য মনে হয়নি। আমাদের দেশের মানুষ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে- এটা বলে আমরা এক প্রকার স্বস্তি বোধ করলেও সময় এসেছে এ বিষয়ে আরো বেশি অনুসন্ধানী হওয়ার। জঙ্গিবাদের শিকড় আমাদের সমাজের গভীরে কতটুকু প্রোথিত হয়েছে তার নির্মোহ অনুসন্ধান প্রয়োজন। আর জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটনের জন্য শুধু পুলিশি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্য কিছুর দিকেও জরুরি মনোযোগ দেয়া দরকার। কারা জঙ্গিবাদে জড়িত হচ্ছে, কেন হচ্ছে- এ ব্যাপারে ওপরভাসা ধারণা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখন এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হওয়া উচিত। মনে করা হয় যে, বর্তমানে জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা জঙ্গি তালিকায় নাম লেখাচ্ছে তারা একটা ভুল বিশ্বাস নিয়ে এই পথে পা বাড়াচ্ছে। তারা ধর্মের জন্য ও শোষণ-বঞ্চনা অবসানের লক্ষ্যে কাজ করছে বলে মনে করছে। আসলে তারা বড় দেশগুলোর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সরাসরি সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার পরিবর্তে এখন বৃহৎ দেশগুলো জঙ্গি লেলিয়ে দিচ্ছে। তাই দেশে দেশে জঙ্গি তৎপরতা থামছে না। নানা নামে নানা কৌশল প্রয়োগ করে জঙ্গিরা তাদের অপতৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছে। মূলত ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের দুটি উঁচু ভবন ‘টুইন টাওয়ার’-এ বিমান হামলার পর থেকে সন্ত্রাসবাদ গোটা দুনিয়ায় পরিচিতি পায়। সে সময় এই হামলার জন্য জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ও এর প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়। আমেরিকার সৈন্যরা আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ২০১১ সালে পাকিস্তানের এবোটাবাদে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে হত্যা করে হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই রাতে ফ্রান্সে নৃশংস ট্রাক আক্রমণে প্রাণ হারালেন ৮৪ জন এবং আরো অধিকসংখ্যক আহত হলেন। এক্ষেত্রে একজন ট্রাকড্রাইভার একটি ট্রাক ফ্রান্সের জাতীয় দিবসে দেশটির নিস নামক শহরে আনন্দ-উল্লাসকারী অসংখ্য মানুষের ওপর দিয়ে চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এটি একটি নতুন কৌশল, যেমনটি নতুন কৌশল ছিল বিমান হাইজ্যাক করে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলা। আবার দেখা যায় এক ব্যক্তি গুলি চালিয়ে অনেককে হতাহত করে, যেমনটি দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরল্যান্ডোতে একটি নৈশক্লাবে। তাছাড়া কয়েকজন মিলে ১৩ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায় ফ্রান্সের প্যারিসে, ২০১৬ সালের ২২ মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এবং ২৮ জুন, ২০১৬ তারিখে তুরস্কের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে। এছাড়া গত কয়েক বছরে ফ্রান্স, জার্মানি ও লন্ডনেও একাধিকবার জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ধরন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতা থাকলেও এসব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড একই সূত্রে গাথা। ইসলাম ধর্মের বিকৃত ও মনগড়া ব্যাখ্যাদানকারী উগ্রবাদীদের প্ররোচনা ও পরিকল্পনা রয়েছে এগুলোর পেছনে। যারা এ ধরনের সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অর্থায়ন করছে এবং বাস্তবে ঘটাচ্ছে এরা প্রায় সবাই দেখা যাচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুশাসনের অপব্যাখ্যাকারী ও বিকৃত ব্যাখ্যাদানকারী বিপথগামী ব্যক্তি। পৃথিবীর কয়েকটি জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম তালেবান, আল কায়েদা, বোকোহারাম, আল শাবাব, ইসলামিক স্টেট বা আইএস। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো দেশীয় জঙ্গিরাই ঘটিয়েছে। দেশে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং হিজবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হলেও এখনো তৎপর রয়েছে। তাছাড়া তৎপর রয়েছে অপেক্ষাকৃত নতুন জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। জঙ্গিবাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীন বিবেকের ঊর্ধ্বে গিয়ে অন্ধভাবে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখেছি, আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানে তালেবান শরিয়া আইনের নামে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। যার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালির ছোট্ট কিশোরী শিক্ষার্থী মালালা ইউসুফজাই কিংবা আফগান নারীদের। আইএস ইরাক ও সিরিয়ার ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়ার পরও সেখানে উগ্রভাবে ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অবৈধভাবে চরমপন্থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেয়া। জঙ্গিবাদীরা মানুষকে আবার অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট, তালেবান ও আল কায়েদার মতো জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে দেশে চোরাগোপ্তা হামলা করছে। প্রাচীন সভ্যতার পুরাকীর্তি, জাদুঘর, গ্রন্থাগার সব ধ্বংস করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব ধ্বংস করে ওরা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এ সহজ কথাটা কি আমরা বুঝতে পারি না? অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে, বাংলাদেশে আজ পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের চোখের সামনে কোনো অন্যায় হলে বা কারো ওপর জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার হতে দেখলেও আমরা প্রতিবাদ করি না। আক্রমণকারী তার কাজ শেষ করে নির্বিঘেœ চলে যেতে পারে, কারণ আমরা ভয়ে কেউ এগিয়ে গিয়ে তাদের প্রতিহত করি না। আমরা ভাবি তা করতে গিয়ে যদি আমরা নিজেদের বিপদ ডেকে আনি? কিন্তু যদি আজ অন্যের বিপদে আমি এগিয়ে না আসি, তবে আমার বিপদের দিনে কাউকে পাশে পাব না। অন্যের ধর্ম, ভিন্ন মতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে প্রশ্রয় পাচ্ছে দানবিক জিঘাংসা। পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের সমাজ ও রাজনীতি থেকে আজ নির্বাসিত। জঙ্গিবাদের প্রধান শক্তি ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অর্থ। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধত্ব আর কুসংস্কার দূর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না। সে সঙ্গে জঙ্গিবাদের অন্যতম শক্তি অর্থ জোগানের উৎস বন্ধ করতে হবে কঠোরভাবে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্তদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, জঙ্গিবাদের মদতদাতা, পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যে-ই হোক, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কেবল সচেতনতা সৃষ্টি করে নয়। সন্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। আমরা যত বেশি তাদের সঠিক তথ্য দেব, তত বেশি তারা জানতে ও বুঝতে পারবে। আমাদের আরো বেশি বেশি সময় দিতে হবে। আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক গল্প করতে হবে। আমাদের মা-বাবারা যে সময়টা আমাদের দিতেন, আমাদেরও উচিত সন্তানদের সে পরিমাণ সময় দেয়া। কিন্তু‘ এখনকার প্রজন্ম তত বেশি সময় সন্তানদের দেয় না। সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে। ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি আন্তরিক সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে কুশিক্ষার দিকে ধাবিত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একাডেমিক পাঠের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের বেশি পরিমাণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তরুণরা ঘর ছেড়ে যাচ্ছে কেন, কেন তারা জঙ্গি দলে নাম লেখাচ্ছে তার কারণ সন্ধান করতে হবে সবাই মিলেই। ঘটনা ঘটার পর আফসোস করে লাভ নেই, প্রতিকারের ভাবনা ভাবতে হবে আগেই। বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App