×

মুক্তচিন্তা

সহনশীলতার চর্চা ও মানবিক দেশ গঠন হোক আমাদের প্রত্যয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ০৩:১৮ এএম

বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পথে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ বলছে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের একটি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো- সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে অধিক হারে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষ উন্নয়নের কোনো সুফল পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের মালিক। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিপরীতে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশের মালিক। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয় হয় কমেছে বা এক জায়গাতেই থমকে আছে। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বাংলাদেশের অভ্যুদয় বইতে লিখেছেন, ‘গণমানুষের এই সর্বাত্মক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অন্য অধিকাংশ সংগ্রাম থেকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। ঠিক এ কারণেই এ দেশে এমন একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার ছিল, যেখানে এই মানুষগুলো তাদের অবদানের স্বীকৃতি পায় এবং তারা একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। তার পরিবর্তে আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুললাম, যা উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যে সমাজটি পেয়েছিলাম তার চেয়েও অধিক বৈষম্যপীড়িত। তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এ রাষ্ট্র, এ জাতি কী শিক্ষা নিল? জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে কেন আমরা পিছিয়ে? মানুষের জন্য ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের প্রেরণা এবং মানুষের কল্যাণই ছিল তার কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য। এই মানবিক মূল্যবোধই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে, যা প্রতিফলিত হয় তার বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে, যেমন গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্র। তিনি প্রায়ই বলতেন, তার সারা জীবনের স্বপ্ন হচ্ছে ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি’ তার এই অভিব্যক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারি সমাজ উন্নয়ন সম্পর্কে তার ধারণা ছিল কত ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রথমেই তার একটি উদ্ধৃতি রয়েছে যাতে তিনি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন প্রথমে মানুষ এবং তারপর বাঙালি হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।’ এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা। তরুণ বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষের সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ১৯৫২ সালে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি চীন সফর করেন, যেখানে বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী এবং মানব মুক্তিকামী সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। আমার দেখা নয়া চীন বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘রাশিয়া হোক, আমেরিকা হোক, ব্রিটেন হোক, চীন হোক, যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সঙ্গে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই।’ বঙ্গবন্ধুর শান্তির দর্শনের অন্যতম উপাদান ছিল যুদ্ধ পরিহার করে যেকোনো বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, সব ধরনের বঞ্চনা ও শোষণমুক্তির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধু সব সময় যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।’ ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায় প্রত্যক্ষ দুটো ব্লকে বিভক্ত হয়ে যায়। নিজেদের প্রভাব বলয় সৃৃষ্টি করতে গড়ে তোলে সামরিক জোটও। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সব শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’ বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ব্যতিরেকে কখনোই বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তাই ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার সম্মানে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না প্রতিশোধ গ্রহণে কোনো মহৎ কর্তব্য পালন করা যায়।’ তিনি বলেছিলেন, আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার বন্ধ্যা নীতির অবসান হবে। আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করে আমরা যেন তা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করি। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব, যেখানে আমরা সু-প্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি এবং যেখানে আমাদের মানুষের মঙ্গলার্থে আমরা গঠনমূলক নীতিমালা অনুসরণ করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’ উপমহাদেশের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যখন শান্তির এই অমিয় বাণী উচ্চারণ করেন, তখনো রণাঙ্গন থেকে রক্তের দাগও মুছে যায়নি, আঞ্চলিক সহযোগিতা বিকাশের এই উদাত্ত আহ্বান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর শান্তির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের পরিচায়ক। এ পৃৃথিবীটা সবার, অন্যের স্বস্তি নিশ্চিত করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে। সবারই মনে রাখতে হবে, বিশ্বনেতা হতে হলে পৃথিবীর যতœ নেয়া শিখতে হবে, বিশ্বনেতা মানেই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণী অর্থাৎ পুরো প্রকৃতির যতœ নিতে শেখা। নিজে আলোকিত হয়ে উঠতে হবে, বিশ্ববাসীকে আলোকিত করে জাগিয়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা সেটা হলো সু-শিক্ষাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। নিজ নিজ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। সমন্বয়ের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত সম্পদ ব্যবহারেও সচেষ্ট হতে হবে। চোরাচালান এবং মাদকের ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কঠোর হতে হবে। যে করেই হোক, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সুন্দর পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এই সুন্দর পৃথিবীটা হলো প্রাণের আবাসস্থল! সু-শিক্ষার আলোতে প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠবে একেকজন সহনশীল এবং মানবিক বিশ্বনেতা। বিশ্বনেতাদের দায়িত্বশীল নেতৃত্বে বিশ্ব ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে একটি সুন্দর বাসযোগ্য ধরণিতে পরিণত হবে। অবরোধ, যুদ্ধ আর নিষ্ঠুরতার ফল কোনোভাবে শুভ হয় না। তাই পৃথিবীর গণমানুষ আজ শান্তি চায়, মনেপ্রাণেই শান্তি চায়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই বৃহৎ শক্তিবর্গের শুভবুদ্ধি। আর এ শুভবুদ্ধিতে বিশ্বে শান্তির দীপশিখাটি প্রজ্জ্বলিত হবে- সেটিই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা। সামাজিক জীবনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় জীবনে সহনশীলতার বড়ই অভাব। আমাদের রাজনীতি থেকে তো সহনশীলতা একবারেই বিদায় নিয়েছে। ভিন্নমতকে দমন করার জন্য পৃথিবীব্যাপী যে অসহনশীলতার চর্চা শুরু হয়েছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীন দেশে ভিন্নমত থাকবে, সমলোচনা থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। নিজের ক্ষমতার শক্তি প্রমাণে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোর ওপর যে হত্যা নির্যাতন চালাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তাদের সর্বোচ্চ সহনশীল হওয়া দরকার ছিল। সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের অধিকার হনন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনে সহনশীলতার চর্চা ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একে অপরের প্রতি সহনশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি ও অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক জীবনে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তথা বয়স্ক, বৃৃদ্ধ ও দুর্বল শ্রেণির প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহনশীল আচরণের শিক্ষা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত। তিনি ১৯৭৩ সালের ২৩ মে জুলিও কুরি শান্তিপদকে ভূষিত হন- যা বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং সেই সম্মান ও মর্যাদার ধারাবাহিকতায় আমাদের সহনশীল ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্রত গ্রহণ করতে হবে। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : কলাম লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App