×

সারাদেশ

বিল কাঠুরিয়ার দুঃখ কাঠুরিয়া খাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ০২:৩৩ পিএম

বিল কাঠুরিয়ার দুঃখ কাঠুরিয়া খাল

ছবি: ভোরের কাগজ

একসময় বোরো ধানের বাম্পার ফলনের জন্য বিখ্যাত ছিল মাঠটি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এখন সেখানে হোগলা বাগান, কচুরিপানা ও আগাছায় ভরে আছে। একটি খাল সংস্কারের অভাব, অপরিকল্পিত মাছের ঘের ও এলজিইডির একটি রাস্তার কারণে প্রায় ৮ বছর ধরে সেখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও আছে একটি সেতু, যা নির্মাণের সময় ব্যবহৃত মাটি অপসারণ করা হয়নি।

মাঠটির নাম বিল কাঠুটিয়া, আর খালের নাম কাঠুরিয়া খাল। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা এবং নড়াইল সদর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে বয়ে গেছে খালটি। খালের দক্ষিণ পাশে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জামদিয়া ইউনিয়ন এবং উত্তর পাশে নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর ও শেখহাটী ইউনিয়ন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিল কাঠুরিয়ার মাঝ দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে কাঠুরিয়া খাল। বিলের উত্তর দিকে নড়াইল সদর উপজেলার বেনাহাটী এলাকা এবং পূর্ব-দক্ষিণে উপজেলার বাকলী বিল। বিলের দক্ষিণে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বাকড়ী এলাকা এবং পশ্চিমে উপজেলার ঘোড়ানাছ বিল। বিলের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কিছুটা উঁচু। সেখানে লম্বাভাবে কয়েকটি মাছের ঘের কেটে মাছচাষ করা হচ্ছে। বিলের বেশিরভাগ অংশ ভরে আছে পানিতে। প্রায় পুরো বিল ছেয়ে আছে কচুরিপানা, আগাছা আর হোগলা গাছে।

বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে খালের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটী-তুলারামপুর সড়ক। উপজেলার হাতিয়াড়া এলাকায় খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে হাতিয়াড়া সেতু। এটি নির্মাণ করার সময় খালে আড়াআড়িভাবে দেয়া হয়েছিল মাটির বাঁধ। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার পরও মাটির বাঁধটি অপসারণ করা হয়নি। সেতুর মুখে খাল অনেকটা উঁচু হয়ে আছে।

সেতু থেকে বিলের দিকে ছোট নালার মতো হয়ে চলে গেছে খালটি। এ ছাড়াও বেনাহাটি, হাতিয়াড়া ও বাকড়ী গ্রামের সংযোগ স্থাপনের জন্য নড়াইল সদর উপজেলা এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বিলের মাঝখান দিয়ে আড়াআড়িভাবে নির্মাণ করেছে ১ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। বিলের পানি প্রবাহের জন্য সেই রাস্তার দক্ষিণ পাশে ৪ ফুট ব্যাসার্ধের একটি পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে।

কয়েকজন কৃষক জানান, বিলে প্রায় ১ হাজার বিঘার মতো জমি আছে। এই জমি খুবই উর্বর। কাঠুরিয়া খালের প্রায় ৪ কিলোমিটার বিলের মধ্যে পড়েছে। আগে খালে জোয়ার-ভাটা হতো। খাল দিয়ে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি বিলে ছড়িয়ে পড়ত। জমি উর্বর হতো। খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হওয়ায় শীতের শেষে বিলটি শুকিয়ে যেত। বিলে তখন বোরো ধানের চাষ হতো। প্রচুর ধান হতো। স্থানীয়ভাবে ‘বোরো ধানের ভাণ্ডার’ নামে পরিচিত ছিল বিলটি। বছরের অন্য সময় পানি থাকায় বিলে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত।

তারা জানান, প্রায় ৭ বছর আগে হাতিয়াড়া এলাকায় খালের ওপর সেতু নির্মাণ করার সময় খালে আড়াআড়ি মাটির বাঁধ দেয়া হয়। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার পরও মাটির বাঁধটি অপসারণ করেননি ঠিকাদার। বাঁধের কারণে খাল দিয়ে আসা জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যায়। খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় খাল দিয়ে বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিল কাঠুরিয়া। সেই থেকে বিলে ধানচাষ হচ্ছে না। এখন বিলের কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর আবার কোথাও বুকসমান পানি।

বিলে এক বিঘা এক কাঠা (৪৮ শতাংশে বিঘা) জমি আছে বাঘারপাড়া উপজেলার বাকড়ী গ্রামের কৃষক অজয় কুমার বিশ্বাসের। তিনি বলেন, ‘৭-৮ বছর আগে বোরো মৌসুমের আগেই বিল শুকিয়ে যেত। বিলে একটিমাত্র ফসল বোরো ধান হতো। বিলের জমি খুবই উর্বর। প্রচুর ধান হতো। কিন্তু হাতিয়াড়ায় ব্রিজ করার পর থেকে ব্রিজের মুখে খাল উঁচু হয়ে যায়। খালে জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিলের জল আর শুকায় না। কয়েক বছর বিলে কোনো ধান হচ্ছে না। খুব কষ্টে আছি।’

একই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক উজ্জ্বল বিশ্বাস (৬১) বলেন, ‘খালপাড়ের জমির মালিকদের মাছের ঘেরের মাটি খালের মধ্যে পড়েছে। এর ফলে জলাবদ্ধতা আরো স্থায়ী হয়েছে।’ এলাকাবাসী জানান, নড়াইল সদর উপজেলার বাকলী এলাকায় ভৈরব নদ থেকে বেরিয়েছে কাঠুরিয়া খাল। এঁকেবেঁকে খালটি বিল কাঠুরিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোগাছি দাড়িরপুর ও কমলাপুর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় নড়াইল সদর উপজেলার বড় মিতনা এলাকায় কাজলা নদীতে পড়েছে। খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ কিলোমিটার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ১ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ টাকা ব্যয়ে হাতিয়াড়া এলাকায় খালের ওপর ২০ মিটার দীর্ঘ একটি গার্ডার সেতু নির্মাণ করে।

হাতিয়াড়া গ্রামের কৃষক সঞ্জয় কুমার বিশ্বাস (৬০) বলেন, ‘খালে আগে অনেক বড় ছিল। ব্রিজ করায় চলাচলে অনেক সুবিধা হয়েছে, তবে জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে খাল একরকম মরেই গেছে।’

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নড়াইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘বিষয়টি অনেক আগের। তার পরও সরেজমিন পরিদর্শন করে বিষয়টি নিয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা দেখা হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘বিল কাঠুরিয়ায় আমাদের ১৫০ থেকে ২০০ বিঘার মতো জমি জলাবদ্ধ আছে। আমরা সরেজমিন গিয়ে বিষয়টি দেখব। এরপর জেলা সমন্বয় সভায় বিষয়টি আলোচনা করে সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করা হবে। বিষয়টি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইলের উপ-পরিচালকের সঙ্গেও কথা বলব।’

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) যশোর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সেচ) মো. আব্দুল্লাহ আল রশিদ বলেন, ‘দ্রুত খালটি পরিদর্শন করা হবে। খালটি খননের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App