×

রাজনীতি

ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর, চলছে ভেন্যু বিতর্ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪৮ এএম

ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর, চলছে ভেন্যু বিতর্ক

ছবি: সংগৃহীত

ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর, চলছে ভেন্যু বিতর্ক

ফাইল ছবি

কৌশলগত অবস্থান থেকে নয়াপল্টনে অটল বিএনপি

রাজনীতির উত্তাপ ‘ক্লাইমেক্সে’। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে আপাতত বাকযুদ্ধে লিপ্ত প্রধান দুই শক্তি- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সেদিন রাজপথে শক্তির ‘খেলা’য় মুখোমুখি হওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেই উভয়পক্ষই। তার আগে সমাবেশের ভেন্যু ঘিরে দুদলে চলছে কৌশলগত খেলা। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে ওইদিন সমাবেশের জন্য বিএনপি তিনটি স্থান বরাদ্দ চাইলেও নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই তারা সমাবেশ করতে অনড়। বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং সংসদ ভবনের সামনের মানিক মিয়া এভিনিউয়ে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপির কাছে আবেদন করেছিল। পুলিশ অনুমতি দিয়েছে বিএনপির দ্বিতীয় পছন্দের ভেন্যু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনে অনড়। প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কেন নয়াপল্টনে অনড়? আর পুলিশইবা কেন সোহরাওয়ার্দীতে আগ্রহী? এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। বিশ্লেষকদের মতে, কৌশলগত সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেই ভেন্যু পছন্দ করেছে বিএনপি। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরে পাল্টা কৌশল এঁটেছে ডিএমপিও (ঢাকা মহানগর পুলিশ)।

কী সে কৌশল? বিএনপি নেতারা চান, সেদিন ঢাকার রাজপথ দখলে রাখতে। তাই সমাবেশ রাজপথেই করতে হবে। এক্ষেত্রে আরো সুবিধা হচ্ছে- রাজধানীর প্রায় সবদিন থেকেই নেতাকর্মীরা সহজেই সমাবেশে যোগ দিতে পারবেন। উৎসুক সাধারণ মানুষও আসবেন। সেক্ষেত্রে সমাবেশে শোডাউন ভালো হবে। তাছাড়া পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠলে এক জায়গায় আটকে না থেকে নেতাকর্মীরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হতে পারবেন। প্রয়োজন হলে পালানোও সহজ হবে। নয়াপল্টনের চারপাশে অনেকগুলো গলি আছে। অতীতে দেখা গেছে- বিএনপি নেতাকর্মীরা ওইসব গলি ব্যবহার করে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। অন্যদিকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেয়াল ঘেরা হওয়ায় নেতাকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে আগ্রহী হবে না। উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার মাত্র দুটি গেট থাকায় এক রকম অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে থাকতে হবে। তাছাড়া ভেন্যুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হওয়ায় ক্যাম্পাসে সেদিন ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থান থাকবে। এই বিষয়টিকেও হুমকি মনে করছেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির ‘ছক’ ধরেই পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএমপি। পুলিশের আশঙ্কা, সেদিন ঢাকায় বড় জমায়েত করতে পারলে রাজপথের নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে বিএনপি। দলটির নেতা আমানউল্লাহ আমান তো বলেই দিয়েছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। সরকারপক্ষ মনে করছে, সমাবেশের নামে রাজধানী দখলের চক্রান্ত করেছে বিরোধীপক্ষ। আমানের কথায় ছিল তারই আভাস। সে কারণে ক্ষমতাসীনরা মনে করছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করলে বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে পুলিশের পক্ষে। প্রয়োজনে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করাও সহজ হবে। অবশ্য বিকল্পও ভেবে রেখেছেন বিএনপি নেতারা। নয়াপল্টন না হলে তৃতীয় পছন্দের ভেন্যু মানিক মিয়া এভিনিউ পেতে আগ্রহী তারা। তবে যে কারণে নয়াপল্টনে আপত্তি, একই কারণে মানিক মিয়া এভিনিউয়েও অনুমতি দিচ্ছে না পুলিশ।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার দুপুরে বলেন, বাধ্য হয়ে সরকার কোথাও

অনুমতি দেবে না। সরকার যেখানে ভালো মনে করে সেখানেই অনুমতি দেয়া হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া বড় সমাবেশ করা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেন্যু বিএনপিই চেয়েছে। ডিএমপি কমিশনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই উপযুক্ত মনে করেছেন, এজন্য বিএনপিকে সেখানেই অনুমতি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের কিছু দলীয় প্রোগ্রাম রয়েছে, সেগুলো শেষ হয়ে যাবে। এরপর বিএনপি সেখানে সমাবেশ করতে পারবে। বিএনপি বলছে, সরকার নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হবে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সব থেকে যেখানে ভালো, সেখানেই সরকার অনুমতি দেয়। তারা পল্টনে সমাবেশ করবে- এমন কোনো অফিসিয়াল অনুমতি এখনো আসেনি। বিএনপি আমাদের কাছে এসেছিল। তারা তিনটি জায়গার কথা বলেছিল। তার মধ্যে একটি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সংসদ ভবনের সামনে কাউকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয় না।

ডিএমপির মুখপাত্র ফারুক হোসেন বলেন, বিএনপির সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। সমাবেশের অনুমোদন দিতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- যেসব মানুষ সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকায় আসবে তাদের নিরাপত্তা কেমন হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা কেমন হতে পারে এবং সমাবেশ নিয়ে কোনো গোষ্ঠীর কোনো ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা আছে কিনা- তা নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। এ ধরনের সব প্রতিবেদন ডিএমপির হাতে এলে সেগুলো বিশ্লেষণ করে তারপরই এই সমাবেশের জন্য অনুমোদন দেয়া হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ প্রসঙ্গে ডিএমপির মুখপাত্র বলেন, কিছুদিন আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের যে সম্মেলন অনুষ্ঠান হয়েছে তারপর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেকগুলো অঙ্গসংগঠন সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি নিয়ে রেখেছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই উদ্যান প্রায় প্রতিদিনই বরাদ্দ করা রয়েছে। ফারুক হোসেন বলেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে বিএনপির কাছ থেকে এই তিনটি জায়গা ছাড়া আর কোনো পছন্দের জায়গা আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়েছে। যার মধ্যে মিরপুরে ফাঁকা জায়গা আছে সেখানে ভেন্যু হতে পারে, ঢাকার সঙ্গে লাগোয়া টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার যে মাঠ আছে সেখানে ভেন্যু হতে পারে। এছাড়া ৩০০ ফুট এলাকায় বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র রয়েছে যেখানে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে সমাবেশ হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে ডিএমপি।

এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলেছেন, নয়াপল্টনে বিএনপি সমাবেশ করতে চায়। সমাবেশের অনুমোদন দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল বিকালে ভোরের কাগজকে বলেছেন, বিএনপি নয়াপল্টনে কমফোর্ট ফিল করে। এখানে ঢোকা-বের হওয়ার ২০-২৫টি পথ রয়েছে। সারাদেশ থেকে লোকজন আসবে। স্থায়ী মঞ্চ না হলে দুটি ট্রাকের উপরও মঞ্চ বানিয়ে সমাবেশ করা যায়। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাত্রলীগের সম্মেলন ভেন্যু। সেখানে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, এরপর বিএনপির মঞ্চ-প্যান্ডেল তৈরি ও অন্যান্য প্রস্তুতির সুযোগ নেই। এছাড়া সেখানে ঢোকা ও বের হওয়ার গেট মাত্র দুটি। পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি দলের লোকজন বাইরে গন্ডগোল বাধালে উদ্যানের ভেতরের লোকজন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। জনগণের নিরাপত্তা বিবেচনা করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, উদ্যানের ভেতরে গাছসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এসবের ক্ষতির মামলা হতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় যেভাবে তল্লাশি করা ও নিরাপত্তা দেয়া হয় বিএনপি তা পাবে না। মানিক মিয়া এভিনিউ বরাদ্দ পেলে সেখানে জনসভা করবেন বলেও জানান তিনি। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আমরা সবসময় পার্টি অফিসের সামনেই সমাবেশ করি, এটা না দেয়ার কিছু নাই। তিনি বলেন, কত লোক হবে সেটা তো বলতে পারছি না, তবে আমাদের সমাবেশগুলো মহাসমাবেশে রূপ নিচ্ছে। সেলিমা রহমান বলেন, ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশটিও বিভাগীয় সমাবেশ হিসেবেই করা হচ্ছে। সেজন্যই আমরা পল্টনেই চেয়েছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা আর কোনো মাঠ বা ভেন্যু নয় কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের তো কোনোদিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেয় না। এজন্যই পার্টি অফিসের সামনে বিএনপি সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছি। পার্টি অফিসের সামনে আমাদের জন্য সুবিধা হয়, সেজন্য আমরা চেয়েছি।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জানান, সমাবেশের জন্য নয়াপল্টনই তাদের পছন্দ। কারণ সবসময় সেখানেই সমাবেশ করে আসছেন তারা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সম্পর্কে তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনেক কিছু তৈরি হয়েছে। সেখানে আসলে তেমন কোনো মাঠ নাই। টুকু বলেন, ঢাকা সিটির মাঝখানে আগে পল্টন ময়দান ছিল যেখানে বিএনপি জনসমাবেশ করত সবসময়, পাকিস্তান আমল থেকে ওখানে সমাবেশ করা হতো, সে মাঠটা আর এখন রাখা হয়নি, সেটা খেলার মাঠ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপিও অঙ্গসংগঠনের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, সরকার পতন আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসে বিএনপি নয়াপল্টনে জনসভার যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে অনেক সিনিয়র নেতা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা নাখোশ। তারা বড় ধরনের শোডাউনের জন্য বড় ভেন্যু চান। এ অবস্থায় নয়াপল্টনে জনসভা করলে নিয়মিত সমাবেশের বাইরে বড় কিছু দেশবাসী বা বিশ্ববাসী দেখবে না বলে তারা মনে করছেন। এ নিয়ে বিএনপির ভেতরেও ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা রাজপথের লড়াই রাস্তায়ই করতে চান। প্রয়োজনে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাস্তায় বসে পড়তে চায় তারা। এমনকি সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে লড়াই বাধলে নেতাকর্মীরা যাতে অলিগলি দিয়ে সরে যেতে পারে তাও ভাবনায় রেখেছে।

প্রসঙ্গত, গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সম্মেলন করার মাধ্যমে বিএনপি প্রায় দুই মাসব্যাপী তাদের কর্মসূচি শুরু করে, যা আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর, সিলেট ও গতকাল কুমিল্লায় সমাবেশ করেছে বিএনপি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App