×

আন্তর্জাতিক

ইউরোপ ধ্বংসের মার্কিন চক্রান্ত ইউক্রেন যুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ০৯:১৭ এএম

ইউরোপ ধ্বংসের মার্কিন চক্রান্ত ইউক্রেন যুদ্ধ

ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপের বড় কোম্পানিগুলোর এক-তৃতীয়াংশ গত ৬ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের ব্যবসায়িক অফিস বা শাখা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- চাহিদা কমে যাওয়া ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। স¤প্রতি ব্রিটেনের ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ভাবছেন ইইউ ব্যবসায়ীরা : সন্ধ্যায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গত সোমবার তার বাসভবনে ইউরোপীয় শিল্পপতিদের সম্মানে এক ভোজের আয়োজন করেন। তিনি এমন একটি সময় এ ভোজের আয়োজন করলেন, যখন ইউরোপে জ্বালানির দাম ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কঠিন সংকটের মুখে পড়েছে। ফ্রান্সের মেটালজিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বক্তব্য অনুযায়ী, ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল গড়ে প্রায় ৪ গুণ বেড়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানির দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।

পাশাপাশি, মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইনের মাধ্যমে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া ভর্তুকির কারণে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রমুখী করে ফেলেছে। এ অবস্থায় অনেক ইউরোপীয় মনে করছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জ্বালানি সংকটের কারণে ইউরোপীয় নির্মাণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসবকে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র বলে মনে করা হচ্ছে।

বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো লড়াই শুরু করেছে। তাদের বেশ কয়েকটি দেশ এরইমধ্যে মার্কিন নীতির বিরোধিতা শুরু করছে। ইউরোপীয় দেশগুলো আন্তর্জাতিক বিষয়ে আরো যুক্তিযুক্ত পথ বেছে নেয়াও শুরু করেছে।

মার্কিন ডলারের আধিপত্য, বিশৃঙ্খল ইইউ অর্থনীতি : ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ গত ২ নভেম্বর আবারো ৭৫ পয়েন্ট সুদের হার বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে ফেডারেল রিজার্ভ টানা ৬ বার সুদের হার বাড়িয়েছে। ফলে ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে সুদের হার হয়েছে সর্বোচ্চ।

মার্কিন সাবেক অর্থমন্ত্রী জন কনালি একবার বলেছিলেন, ‘ডলার আমাদের মুদ্রা, তোমাদের সমস্যা।’ যখন বিশ্ব অর্থনীতি করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষের নেতিবাচক ধাক্কা সামলাচ্ছে, তখন সাবেক মার্কিন অর্থমন্ত্রীর কথা যেন আবারো সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হলে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে পুঁজি আকৃষ্ট করবে, যা অন্যান্য দেশের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাবে, ঋণ পরিষেবার খরচ বাড়াবে। এর ফলে কিছু দেশ মুদ্রা বা ঋণ সংকটে পড়ে যাবে।

ডলারের আধিপত্য হল আর্থিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যের প্রতিফলন এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের জন্য সমর্থনও বটে। তাই নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চাইলে, যুক্তরাষ্ট্রকে ডলারের আধিপত্যও বজায় রাখতে হবে। যুদ্ধ, জবরদস্তি ও আর্থিক সন্ত্রাসের মাধ্যমে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন, গত শতাব্দীর ’৮০র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দ্রুত বেড়ে যায় এবং ইয়েনের আন্তর্জাতিকীকরণ এগিয়ে গেলে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

এ ‘সমস্যা’ সমাধানে জাপানের মতো মিত্র দেশের ওপরও জবরদস্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাজ্য স্বাক্ষর করে প্লাজা চুক্তি। জাপানের রপ্তানির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জাপান দীর্ঘসময়ের অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে যায়। ইয়েনের বিশ্বায়নও থমকে দাঁড়ায়। ১৯৯৯ সালে যখন ইইরো জন্ম নেয়, তখনও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও দমনের মুখে ছিল।

পেট্রোডলারের নিরাপদ অবস্থান : যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল পেট্রোডলার ব্যবস্থা এবং প্রধান বাণিজ্য মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখা। চলতি বছরের শুরু থেকে, ইউক্রেন সংকট এবং ফেডারেল রিজার্ভের আক্রমণাত্মক সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ইউরো, ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের মতো মুদ্রার মূল্য হ্রাস পেয়েছে, তবে ‘নিরাপদ’ মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান জোরদার হয়েছে। নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশিরভাগ দেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে স্বাভাবিক ব্যাপার।

মার্কিন ডলারের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি আসলে কিছু দুর্বল অর্থনৈতিক সত্তাকে আঘাত করেছে। ডলারের ঘাটতি শ্রীলঙ্কাকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত পুরো দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়। ডলারের সঙ্গে বিনিময়ের হারে পাকিস্তানি রুপি রেকর্ড পরিমাণ নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। যা পাকিস্তানকে তার বৈদেশিক ঋণ খেলাপির দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। যেহেতু বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ বাণিজ্য ডলারে হয়, তাই ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোর পর ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তুরস্কের আমদানিকৃত জ্বালানি, খাদ্য এবং কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুমান অনুসারে, নিম্নআয়ের দেশগুলোর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ দেশ ঋণ সংকট বা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

সতর্ক সৌদি আরবও : সৌদি আরব একটি প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং পেট্রোডলার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সম্প্রতি অপরিশোধিত তেল উৎপাদন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমাতে সৌদি আরবকে উৎপাদন বাড়াতে বলে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি। বিশ্ব অর্থনীতির ডি-ডলারাইজেশন (ডলারের আধিপত্য কমানো) এর প্রবণতা তীব্রতর হচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। স্পষ্টতই, যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খল আর্থিক নীতি বাজারে আস্থা আনতে পারছে না, পারছে কেবল বহু দেশের অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা আনতে। বিশ্ব তাই এখন ডলারের বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক।

জার্মান ও ফ্রান্স আসলে কোন পক্ষে : গত সোমবার সিএনএন পর্তুগালের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের আগে ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়া আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে এসব দেশ খুব তাড়াতাড়ি ইউক্রেনকে বশে আনার পক্ষে ছিল। তার ভাষায় ইউক্রেনকে তাড়াতাড়ি ‘ফোল্ড’ বা ভাঁজ করার পক্ষে ছিল।

জার্মান মুখপাত্র দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, আমরা জানি যে খুব বিনোদনপ্রিয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সবসময় সত্যের প্রলাপ বকেন। তবে ইউক্রেনের বিষয়ে জার্মানি অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় ধীর ছিল যা ইউক্রেন সরকার নিজেও সমালোচনা করেছে। জনসন ইউক্রেন বিয়য়ে ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের মনোভাব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App